নিউজ ডেস্ক: তিস্তার পানি নামলেও কমেনি নদীপারের মানুষের ভোগান্তি। চরাঞ্চলের অনেক বাড়িতে এখনো জমে আছে বানের পানি। ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড পাকা সড়ক। প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়া সড়কের পাশের ঘরবাড়ি মাটিতে পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। কোথাও কোথাও উপড়ে গেছে গাছপালা। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে। চরে আবাদ করা সব আগাম ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন চরের চাষিরা। কালের কণ্ঠ
পানি নামতে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা উঁচু স্থানে ঠাঁই নেওয়া কিছু মানুষ নিজের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। উজানে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় উত্তরের চার জেলায় গেল মঙ্গলবার রাত থেকে দেখা দেয় এই আকস্মিক বন্যা। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপত্সীমার ৪৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এরই মধ্যে বন্যাকবলিত রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার জন্য আলাদাভাবে ৫০ মেট্রিক টন চাল, পাঁচ লাখ টাকা, চার হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, পশুখাদ্যের জন্য আরো দুই লাখ টাকা এবং ১০০ বান্ডেল করে ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় জেলার পাঁচ উপজেলার ১৭ ইউনিয়নের ২৯ হাজার ৭১৩ পরিবারের এক লাখ ১৭ হাজার ২৫২ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তার ঢলে অসংখ্য পাকা ও কাঁচা রাস্তা ভেঙে গেছে। কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্রিজ-কালভার্ট। নদীতীরের অনেক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কয়েকটি এলাকার বাঁধ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা সেতুর সংযোগ সড়কের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গত বুধবার থেকে কালীগঞ্জের কাকিনা হয়ে রংপুরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাস ভেঙে যাওয়ায় লালমনিরহাটের বড়খাতা হয়ে নীলফামারীর সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা ও সদর উপজেলার কিছু এলাকায় এখনো রয়ে গেছে বন্যার পানি।
সুখের চরের ষাটোর্ধ্ব নয়া মিয়া তিন দিন পর গতকাল বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরেছেন নিজের বিধ্বস্ত বাড়িতে। সঙ্গে এনেছেন সরকারি ত্রাণের একটি প্যাকেট। দেখা গেল, পানির তোড়ে তাঁর দুটি ঘর এর নিচের মাটি খালে পরিণত হয়ে সেখানেই ভেঙে পড়েছে। পাশে থাকা গোয়ালঘরে ঘুমানোর জন্য বিছানা ঠিক করছেন তাঁর স্ত্রী। নয়া মিয়া বলেন, ‘আমার বয়সে এ ধরনের বন্যা কখনো দেখিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার ঘর ভেঙে পড়েছে, ভেসে গেছে সব কিছু। আমরা কোনো রকমে কোমর সমান পানি পেরিয়ে সরে যেতে পেরেছি।’ তিন দিন তাঁরা ছিলেন অন্যের বাড়িতে। রাতে রান্না হবে ত্রাণের চাল-ডাল। প্রতিবেশী জোবেদা বেগম বলেন, ‘বানের পানিতে আমার একটি ঘর পুরো ভেঙে গেছে। যেভাবে পানির ঢেউ এসেছে, তাতে কোনো কিছু রক্ষা করা যায়নি। শুধু কোনো রকমে আমাদের জীবনটা বেঁচেছে।’
সুখের চরের নয়া মিয়া কিংবা জোবেদা বেগমের মতো লালমনিরহাটের তিস্তা চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ‘হঠাৎ’ আসা বন্যায় হয়েছে নিঃস্ব। দুর্ভোগে পড়েছে যোগাযোগসহ খাবারের কষ্টে। অনেকের কষ্টে লাগানো আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত হয়েছে বিনষ্ট। ফলে এসব মানুষ দিন কাটানো নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে।
কাকিনা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রুদ্রেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির একটি নতুন আধাপাকা ভবন বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে পড়ে আছে। আরো দুটি ভবন পানির তোড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটি তিনতলা ভবন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার দুপুরের দিকে হঠাৎ করে চার ফুট উঁচু পানির ঢল এসে প্রথমে একটি ভবন ভেঙে পড়ে। পানির চাপে সন্ধ্যায় ভেঙেছে আরো দুটি ভবন।’
এদিকে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের গতিয়াশাম, খিতাবখা, ঠুটাপাইকর, থেতরাই ও বজরা এই পাঁচ পয়েন্টে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। অনেকেই নৌকাযোগে ঘরবাড়ি সরিয়ে এনে রাখছে রাস্তার ওপর। রাজারহাটের চর গতিয়াশামের বাসিন্দা কাদের মিস্ত্রি জানান, গত বুধবার রাতে হঠাৎ ঢল আসায় তাঁদের সব ঘর বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কোনোমতে জীবন বাঁচিয়ে তাঁরা সরিষাবাড়ীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, প্রাথমিক হিসাবে ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে ডুবে আছে। রাজারহাটের চর গতিয়াশামের বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন জানান, এক একর জমিতে আগাম জাতের আলু লাগানোর এক সপ্তাহের মধ্যে বন্যাকবলিত হয়ে ক্ষেতের সব বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষেতের ওপর তিন-চার ফুট পানি প্রবাহিত হওয়ার পর বালু আর পলি পড়েছে।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন : এদিকে গতকাল বন্যা ও ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনে যান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের কাকিনা মহিমা রঞ্জন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বন্যাকবলিত লোকজনের হাতে ত্রাণ তুলে দেন। পরে দুপুরে তিনি রংপুরের গঙ্গচড়া শেখ হাসিনা সেতুর সংযোগ সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যান। এর আগে সকালে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের গতিয়াশাম এলাকায় ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তিনি স্থানীয় সরিষাবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
লালমনিরহাটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে এই বন্যা হয়েছে। এটাকে ফ্লাশ ফ্লাড বলা হয়। এর আগে ২০১৭ সালে হাওরাঞ্চলে এ ধরনের বন্যা হয়েছিল। সেখানেও আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারেনি। এখানেও আগাম বার্তা দিয়ে মানুষকে সতর্ক করা হয়নি। ফলে এখানে আমাদের দুর্বলতা ছিল। এই দুর্বলতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।’
এদিকে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের গতিয়াশাম এলাকার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘ভাঙন স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে তিস্তায় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সরকার। এ প্রকল্পের ডিজাইন ও প্রজেক্ট প্রফাইল শেষ হয়েছে। এটি অনেক বড় প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তিস্তাপারের মানুষের আর দুর্দশা থাকবে না