অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: শেখ রাসেল আজ বেঁচে থাকলে একজন পরিণত মানুষ হতো। বঙ্গবন্ধু ৫৫ বয়সে হত্যার শিকার হন। বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালীন বয়সকেও অতিক্রম করে যেতো রাসেল। শেখ রাসেলকে আমরা হারিয়েছি যখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর ১০ মাস। একটি নিরাপদ শিশু। খুনিরা তাকেও রেহায় দেয়নি। হত্যা করেছিলো। হত্যার আগে রাসেল বলেছিলো, ‘আমাকে আমার মায়ের কাছে যেতে দাও’। হত্যাকারীরা কতো নৃশংস, তাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছিলো। এটা মানবতার বিরুদ্ধে যে কতোবড় অপরাধ সংঘটিত হয়েছিলো ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে, তা এখন সারা পৃথিবী অবগত।
শেখ রাসেল অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান ছেলে ছিলো। তার বড় বোন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে লিখেছেন, শেখ রাসেল ছোটবেলা থেকেই স্বকীয়তা নিয়ে চলাফেরা করতো। তার খেলাধুলা ও ছোট একটি সাইকেলকে ঘিরে জীবন আবর্তিত হতো। যখন শেখ রাসেলের জন্ম হয়, তখনো বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিক সফরে ঢাকার বাইরে ছিলেন। রাসেল যখন ছোট শিশু তখন বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেল সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন।
রাসেলের যখন ১৮ মাস বয়স, তখন পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য মা ও ভাইবোনরা গিয়েছিলো কারাগারে, বঙ্গবন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো রাসেল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটা আমার বাড়ি, তুমি তোমার বাড়িতে যাও। এটা যে কতো হৃদয়বিদারক স্মৃতি মূল্যায়ন দুঃসাধ্য। ৫৫ বছর জীবনকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসাধারণ ভ‚মিকা রেখে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জন্য কাজ করে গিয়েছিলেন, তার পরিবারের অনেকের মধ্যেই সে সম্ভাবনা ছিলো। শেখ রাসেলও বেঁচে থাকলে এ দেশ, এ দেশের মানুষের জন্য অবদান রেখে যেতে পারতো।
দেশের জাতির জনকের সন্তান হয়েও ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সে যখন স্কুলে যেতো, প্রত্যেকের সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলা, সবার সঙ্গে সহজ-সরলভাবে কথা বলা ছোট বয়সের উদার মনের পরিচায়ক। তার পরিবারের যে সৌর্য, বীর্য, ক্ষমতা ছিলো আচার-ব্যবহারে ছিলো না। সাধারণ একজন শিশুর মতো স্কুলে যেতো। একইভাবে স্কুল থেকে বের হতো। ওই সময়ে তার সঙ্গে যারা লেখাপড়া করেছিলো, তারা স্মৃতিচারণে বিভিন্ন সময়ে বলেছে যে, আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম সবার আগে স্কুলে এসে রাসেল কুশল বিনিময় করতো। এগিয়ে আসতো। কথা বলতো। একেবারে নিরহংকারী। নির্বিবাদী ছেলে ছিলো। তাকে যে কেউ হত্যা করতে পারে। মেরে ফেরতে পারে তা আমাদের চিন্তারও বাইরে ছিলো।
শেখ রাসেলের জীবনটাই তো দশ-এগারো বছরের। তাকে যারা স্কুলে পড়িয়েছেন, বাড়িতে যারা পড়িয়েছেন তাদের প্রত্যেকের কথায় একটা বিষয় ফুটে ওঠে শিক্ষকদের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা, সেটি ছিলো অপরিসীম। তার গৃহশিক্ষক গীতালি চক্রবর্তী, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন শেখ রাসেলকে। গীতালি চক্রবর্তী বলেছিলেন, আমি যেদিন রাসেলকে পড়াতে যেতাম, প্রথমে সে ব্যস্ত হয়ে পড়তো আমাকে কী খেতে দেবে তা নিয়ে। মিষ্টি বা অন্য যেকোনো কিছু দিয়ে আমাকে বলতো, আপনি আগে খান, তারপর আমি পড়া শুরু করবো। একজন অতিথিবৎসল একটি শিশু ছিলো।
এখন যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বসবাস করছে দেশে, অনাগত দিনে সবার কাছে শেখ রাসেল মানবতার এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে সবসময় তাদের উপস্থিত থাকবে। শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে ৫৭ বছর বয়সী একজন মানুষ থাকতো ঠিকই, তবে আমরা ১০ বছরের শিশুকে দেখে সবসময় অভ্যস্ত। আজ থেকে ৫০ বছর পরও শেখ রাসেল ১০ বছরের শিশু হিসেবেই থাকবে। শিশুরা তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে।
পরিচিতি : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়