ডা. মনোজ দাশ: ‘সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে মানুষের সম্প্রদায়গত পরিচিতির একটি মতাদর্শ এবং এই মতাদর্শের ভিত্তিতে সম্প্রদায়গত রাজনীতি।’
[১] ‘সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করে।’ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ডিসকোর্সের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠন বিকাশে একটা বড় বাধার সৃষ্টি করেছে। ‘সাম্প্রদায়িক পরিচিতি সত্তার রাজনীতি’ শ্রেণি সমাবেশ ঘটাতে বাধা প্রদান করছে। যার ফলে মেহনতী মানুষের সংগ্রামকে দিগ্ভ্রান্ত করে শোষক শ্রেণির ক্ষমতায় টিকে থাকা সহজতর হয়েছে। নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপদে আছে। এজন্য ‘সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করার দৃঢ় সংগ্রাম ব্যতিরেকে বৈপ্লবিক সংগ্রামের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
[২] ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি প্রধানত এ দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দ্বারাই গঠিত হয়েছে।’ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা শুধু ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়নি, বরং তা শাসকশ্রেণির দ্বারাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি তৈরি হয়েছে লুটেরা পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির কারণেইÑ তাদের স্বার্থে ও ব্যর্থতায়। আমাদের দেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িকতা আজ পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির সমগ্র অংশের ব্যর্থতা ও স্বার্থের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।
[৩] মৌলবাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক সাম্রাজ্যবাদ সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও তার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মতাদর্শিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে বিরাট অবদান রেখেছে।
[৪] ‘বামপন্থি দলগুলোও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।’ বামপন্থিরা শাসকশ্রেণির ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের বড় ধরনের কোনো সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে একটি সক্রিয় রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রচার অভিযান সংগঠিত করা হয়নি। বুর্জোয়াদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথবা বুর্জোয়াদের ওপর নির্ভর করে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলার কথা ভাবা হয়েছে।
[৫] ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার প্রশ্নে মার্কসবাদীদের মধ্যে নীতি ও কৌশল নিয়ে মতভিন্নতা আছে।’ মার্কসবাদীদের মধ্যে অনেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি হালকা করে দেখেন। তারা শুধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকেই গুরুত্ব প্রদান করেন। অনেকে আবার সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ককে যান্ত্রিকভাবে দেখেন। আবার কেউ কেউ সাম্প্রদায়িকতাকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে অভ্যস্ত।
[৬] ‘আমাদের দেশে অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও শক্তির অভাব নেই। দরকার একটি নীতি ও কৌশলের ভিত্তিতে তাদের ঐক্যবদ্ধ করা।’
প্রথমত: সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে সামগ্রিক ও সর্বাত্মকভাবে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। অন্য সব সাম্প্রদায়িকতার মতো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাও গঠিত অনেকগুলো উপাদানের দ্বারা। তার বহিঃপ্রকাশও হয় একাধিক উপাদানের মিশ্রণে। সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবেলাও করতে হবে একাধিক উপায়ে, অনেক উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা সর্বাগ্রে একটি মতাদর্শ ও সেই মতাদর্শভিত্তিক রাজনীতি, এজন্য সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে হবে ওই মতাদর্শ ও রাজনীতিবিরোধী সংগ্রামের মধ্যে। উত্তর আধুনিকতার মতো কেবল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময় অথবা নিছক কোনো ইস্যু নিয়ে সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের বিলুপ্তি ঘটাবে না। দ্বিতীয়ত: বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন পর্বে আমাদের মতো দেশে বুর্জোয়ারা সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে না বা তাকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনে অগ্রসর করতে পারে না। এ কাজ করতে হবে বাম- গণতান্ত্রিক শক্তিকে। নিয়ামক শক্তি হিসেবে গ্রাম-শহরের মেহনতী মানুষকে সংগঠিত করতে হবে।
বস্তুগতভাবে সমাজের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক অংশ গ্রাম ও শহরের মেহনতী মানুষ। এই মেহনতি মানুষই সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে প্রধান শক্তি হয়ে ওঠতে পারে। এক্ষেত্রে দরকার তাদের রাজনৈতিক-আদর্শগতভাবে সংগঠিত ও শিক্ষিত করে তোলা। ‘প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার আঁধারে বিপ্লবী শ্রেণি চেতনার ভাবাদর্শগত অস্ত্রে মেহনতীদের সংগঠিত করাই হবে বামপন্থিদের প্রধান কাজ। মেহনতী মানুষ যে মাত্রায় সংগঠিত ও সচেতন হবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম জয়যুক্ত হওয়ার ততোই সম্ভাবনা তৈরি হবে।’ মধ্যবিত্তের যে অংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল দিকগুলো ও মুক্তিযুদ্ধের গণচেতনায় আস্থা রাখে তাদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকায় তাদের সংগঠিত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের ফলে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হয় নারী। এজন্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নারীসমাজ রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ধর্ম সাম্প্রদায়িকতাবাদের মূলে থাকে না, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজন না থাকলেও অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষেত্রে ধর্মের অনুপ্রবেশকে রোধ করতে হবে। বিশেষ করে ধর্মকে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জগৎ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
মৌলবাদবিরোধী সংগ্রামে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে এর শক্তিশালী হাতিয়ার। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই হাতিয়ারটি হলো ধর্মের লৌকিক ভাষ্য।
শুধু লৌকিক ধর্মই নয়, শাস্ত্রীয় ধর্মকে প্রতিক্রিয়াশীল ভাষ্য থেকে উদ্ধার করে সেসবের মধ্যে সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের অন্তঃসারকে উদ্ঘাটন করেছেন যেসব মনীষী সেসব মনীষীর শিক্ষাও মৌলবাদবিরোধী লড়াইয়ে কাজে লাগাতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং ধর্মনিরপেক্ষকরণের মধ্যে প্রভেদ বুঝতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের ধর্মনিরপেক্ষকরণের সংগ্রাম একই সঙ্গে চালাতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্তর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এককভাবে তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক স্তরকে অবহেলা করা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতাবাদের তাত্ত্বিক বা সাম্প্রদায়িক নেতৃবর্গ ও তাদের সাম্প্রদায়িক অনুগামীদের মধ্যে পৃথকীকরণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সাম্প্রদায়িক অনুগামীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ বা হেনস্থা করা উচিত নয়। তাদের দেখতে হবে সাম্প্রদায়িকতাবাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হিসেবে এবং যাদের সামাজিক অবস্থা তাদের সেদিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তা কাটিয়ে ওঠতে বন্ধুত্বপূর্ণ সাহায্য করতে হবে। মনে রাখা দরকার, উপমহাদেশের বিশেষ সামাজিক বিকাশের দরুন বস্তুগতভাবে অসাম্প্রদায়িক শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষকদের একটা বড় অংশের মধ্যেও এটা ছড়িয়ে আছে।
উদারপন্থি সাম্প্রদায়িকতাবাদ এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝা দরকার। কিন্তু তা উদারপন্থি সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম এড়ানোর জন্য বা তার প্রতি অপেক্ষাকৃত নরম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার জন্য বা তাদের ওপর ন্যায্যতা প্রদান করার জন্য নয়। প্রভেদ করা প্রয়োজন, কারণ এই দুই সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা করতে হবে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে। উদারপন্থি সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা করতে হবে অনিবার্যভাবে মতাদর্শের মাধ্যমে, যেখানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে হবে। যেহেতু সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে ওঠার পেছনে শুধু মৌলবাদ নয়, দেশীয় পুঁজি ও আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বার্থ ও হাত রয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা শাসকশ্রেণির সব অংশেরই একটি ভূমিকা ও স্বার্থ আছে, এজন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ শাসকশ্রেণির কোনো অংশেরই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুস্পষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা নেই।
এজন্য সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে নীতিনিষ্ঠ বামপন্থিদের থাকতে হবে চালিকা শক্তির ভূমিকায়। জাতীয় আন্দোলনে বামপন্থিদের থাকতে হবে ঐক্যবদ্ধ, নিতে হবে স্বাধীন ও সৃজনশীল উদ্যোগ। বুর্জোয়া রাজনীতির বিপরীতে গড়ে তুলতে হবে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প। সাম্প্রদায়িকতা-সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা পুঁজিবাদকে পরাস্ত করে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের শ্রেণিগত ও অন্যান্য ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে পরিচালিত গণসংগ্রামের ধারায় তাদের সচেতন ও সংগঠিত করে রাজনীতি ও সমাজে বর্তমান শাসক-শোষক শ্রেণির আধিপত্য খর্ব করে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মতো বিকল্প শ্রেণিশক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটিকে দেশ ও বিশ্ব পরিসরে শ্রেণিকাঠামোর মধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল আধারে বিপ্লবী শ্রেণিচেতনার ভাবাদর্শগত অস্ত্রে মেহনতীদের সংগঠিত করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মতাদর্শিক সংগ্রামের সূচনা করতে হবে। Manoj Das-র ফেসবুক ওয়ালে লেখাটি পড়ুন।