বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও জাতির এক প্রচণ্ড সংকটকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তারা তার শিশু সন্তান রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। সেই সময়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তার দুইকন্যা যদি দেশে থাকতেন তারাও সেই রাতে নিহত হতেন, এটা অবধারিত ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে তারা বিদেশে ছিলেন বলে প্রাণে বেঁচেছেন। দীর্ঘকাল তাদের দেশে ফেরার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। তিনি ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অতিথি হিসেবে। আওয়ামী লীগ যখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, সেই সময়ে যখন একের পর এক আঘাত আসছিলো আওয়ামী লীগের ওপরে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশিরভাগ জেলে না হলে দেশান্তরিত, এরকম বিপর্যস্ত অবস্থায় তিনি ১৯৮১ সালে দেশে ফিরেছিলেন এবং সেই থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই সময় ধরে তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সংখ্যাগত দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ভারতে বিজেপি, তারপর চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর পরে হচ্ছে আমেরিকান দুই পার্টি (রিপাব্লিক ও ডেমোক্রেট), এর পরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। প্রাচীনত্ত্ব ও সংখ্যাগত দিক থেকে আওয়ামী লীগ পৃথিবীর পঞ্চম/ষষ্ঠ বৃহত্তম পার্টি। এতো বড় একটা দল এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য এ পর্যন্ত ১৯ বার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে যারা সপরিবারে হত্যা করেছিলো তারা থেমে যায়নি। যতোক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে আনেছ তাদের এই হত্যাপ্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যেহেতু শেখ রেহানা রাজনীতিতে কোথাও নেই, তিনি বেশিরভাগ সময় দেশেও থাকেন না। সেজন্য তিনি হত্যাচেষ্টা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন! কিন্তু শেখ হাসিনার ওপর মোট ১৯ বার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেই আঘাত থেকে আহত হয়ে তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। বিএনপি সরকারের উদ্যোগে ও বিএনপি-জামায়াত সরকার এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলো। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে যে নজিরবিহীন কারচুপি ও আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হয়েছে। উপর্যপুরি হামলা, হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণ নির্যাতন হয়েছে সারাদেশে। আমি কখনো আওয়ামী লীগ করিনি, এখনও আওয়ামী করি না, কিন্তু সেসময় আমার মতো লোকজনকেও বিপদে ফেলা হয়েছিলো। তখনই দেখিছি যে শেখ হাসিনা কতোটা অবিচল ছিলেন। বিভিন্ন সংঘাতের ভেতর দিয়ে এবং সংকটের মধ্যে তার অবিচল থাকার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এটা তিনি তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য রাজনৈতিক উত্তোরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতার প্রজ্ঞা, মেধা, যেকোনো সংকটে অবিচল থাকার বিষয়টি তিনি পিতার কাছ থেকে উত্তরাধীকার সূত্রে পেয়েছেন। প্রশাসনিক দক্ষতার দিক থেকে তিনি তার পিতাকে অতিক্রম করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করেছিলেন। তখন পরিবেশ অনুকূলে ছিলো, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ জানতো এতো বড় একটা গণহত্যা হয়েছে, এটার বিচার হবে। আন্তর্জাতিকভাবে তখন এখানে কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিলো। পাকিস্তানপন্থীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার এটাও একটা কারণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই বিচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই বিচার শুধু বন্ধ করেই দেননি, তিনি দালাল আইন বন্ধ করে বিচার বন্ধ করার পাশাপাশি যাদের শাস্তি হয়েছে তাদের সবাইকে তিনি জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন এবং তাদের রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা ছিলো, সেই সাংবাধিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে নিয়ে এলেন। সেই থেকেই বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের নামে সন্ত্রাসের রাজনীতি, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আমরা দেখছি। যা এখনো নির্মূল হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে তার সরকার গঠন করতে হয়েছে। তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা। জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ করে বিচারের পথটা বন্ধ রেখেছিলো। তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর হত্যা বিচার শুরু করেন। সেই সময়টাতে বিভিন্নভাবে তাকে হত্যাচেষ্টা করা হলো। হত্যাকারীরা সে সময় সফল হয়নি। শেখ হাসিনা নিজেও বিশ্বাস করেন তার উপর আল্লাহর রহমত আছে। ২০০১ সালে মহাবিপর্যয় ব্যাক্তিজীবনেতো বটেই দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নকশা করা হয়েছিলো সেখান থেকেও তিনি ফিনিক্স পাখির মতো দলকে বের করে এনেছেন এবং সংগঠিত করেছেন। তার ফল হিসেবে তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। যে নির্বাচন নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো কারচুপির অভিযোগ করেনি। সেই নির্বাচনে ম্যান্ডেড অনুযায়ী তিনি যুদ্ধাপরাধীর বিচার আরম্ভ করেছেন। যে বিচারের বিরুদ্ধে তখন জাতিসংঘ থেকে শুরু করে পাকিস্তান, তুরস্কসহ বহু দেশ থেকে বাধা এসেছে। প্রত্যক্ষভাবে টেলিফোন করে বলা হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি কোনোটাকেই পরোয়া করেননি। ১৯৯২ সালে আমাদের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রথম সভাতেই তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে আমার বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মাটিতে আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবো। তিনি কথা রেখেছেন। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইবোনাল গঠন করা হয়েছে এবং বিচার কাজ অব্যাহত রয়েছে। এটা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিলো চল্লিশ বছর পর বিচারটা শুরু করা। কারণ ১৯৭৫ সালে পর বেশিরভাগ সময় এই যুদ্ধাপরাধীরাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিলো। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা যাবতীয় তথ্য-প্রমাণগুলো নষ্ট করে ফেলেছিলো। সরকারি নথিপত্র, মামলার কপি, অভিযোগনামা সবকিছু সিস্টেমেটিক্যালী তারা নষ্ট করে ফেলেছিলো। এতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং সীমিত সম্পদ এবং রসদ নিয়ে আমরা দ্রুত ট্রাইবোনাল গঠন করে আমরা বিচার কাজ আরম্ভ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার যে সাফল্য, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় বিশে^র ও উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, দৃষ্টান্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উল্লেখ করছে। এটা নিশ্চয়ই জাতি মনে রাখবে। আমি মনে করি বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি অক্ষয় হয়ে থাকবেন একাত্তরের গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের দেশীয় আইন ও বিচারব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবোনাল করে বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। গুরুত্বপূর্ণ সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করে তিনি আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থাতে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর বহু দেশে গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিন্তু তারা বিচার করতে পারেনি। ভিয়েতনামে বাংলাদেশের চেয়েও বড় গণতহ্যা হয়েছিলো কিন্তু এখনো পর্যন্ত তারা বিচার করতে পারেনি। কম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে বিশাল খরচ করে হাইব্রিড কোর্ট গঠন করে আমাদের দু’বছর আগে শুরু করে মাত্র তিনজনের বিচার করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে আমরা ইতোমধ্যে ৫০ জনের মতো অপরাধীর বিচার শেষ করে ফেলেছি। এই যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে। আমি মনে এর জন্য শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাকে মনে রাখবে।
পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে সারা পৃথিবী আজকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। যেভাবে বিশ্বে উষ্ণায়ন হচ্ছে এবং অপরিকল্পিত শিল্পনীতি ও শিল্পায়ন হচ্ছে। এর ফলে আগামী ৩০-৪০ বছরে পৃথিবীর বহু দ্বীপ রাষ্ট্র সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশেরও এক-তৃতীয়াংশ সমূদ্রের নিচে চলে যেতে পারে। জলের স্তর বাড়ছে, ওজন লেয়ার কমছে। এগুলো সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে বিশ্বের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করেছে। এর ফলে বিশ্বনেতারা তার খুব প্রশংসা করছে। যদিও বাংলাদেশ এ ব্যাপারে বেশি কিছু বলা হয় না আমাদের জানার অভাবে বা জ্ঞানের অভাবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা উন্নয়নশীল দেশের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো অপরিকল্পিত শিল্পায়ন নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। তাদের এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং সেই ক্ষতিপূরণ তিনি আদায়ও করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে সম্মেলনের পরে সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
প্যারিস সম্মেলনে তার বক্তব্য এবং প্রস্তাব আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। এখন শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের জনগণের নেত্রী নন। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে, পরিবেশ বিপর্যয়ের মোকাবেলার যুদ্ধেও তিনি সারাবিশ্ব নেতৃত্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তাকে এখন বিশে^র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন মনে করা হয়। ক্ষমতার কোনো অপব্যাবহার তিনি করেননি। যে কয়জন সৎ রাষ্ট্রপ্রধান আছেন সে তালিকাতে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো রেকর্ড নেই। বহু রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা তার একটা সততা। তিনি এটা উত্তরাধীকার সূত্রে পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে সম্পূর্ণ নির্লোভ অবস্থানে থেকে মানুষের জন্য কাজ করছেন। নিজের পরিবারের কথা তিনি ভাবেননি, পরিবারের সন্তানের কল্যানের কথা তিনি ভাবেননি। পুরো জীবন তিনি জনগণের জন্য ব্যয় করেছেন। জনগণের জন্য নিজের জীবন দিয়েছেন। শেখ হাসিনাও তাই করে যাচ্ছেন। তার পিতার অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাপ্ত করছেন। যেহেতু ১৯৭৫ সালের পর থেকে দীর্ঘকাল স্বাধীনতাবিরোধীরা, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও পাকিস্তানপন্থীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাব ক্ষমতায় ছিলো। ক্ষমতার রাজনীতিতে এখনও সক্রিয়। এখনো তারা নানাভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাপ্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জঙ্গিদের কাছে যতোগুলো হিটলিস্ট গত কয়েকবছরে পাওয়া গেছে সবগুলো হিটলিস্টের এক নম্বর নাম কিন্তু শেখ হাসিনা। জীবনের একান্ত ঝুঁকি নিয়েই শেখ হাসিনা কাজগুলো করে যাচ্ছেন। তার জন্মদিনে জাতির তরফ থেকে তাকে অভিনন্দন জানাই এবং তার দীর্ঘজীবন আমরা কামনা করি যাতে তিনি যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন, বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। আমরা সেটার বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করি। তিনি নেতৃত্বে থাকলে আমরা অবশ্যই জাতির যে স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধু ও গোটা বাঙালি জাতির স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো।
পরিচিতি : ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমিরুল ইসলাম