সমকাল: সকাল থেকে নানা জাতের মাছের হাট বসেছে কক্সবাজারের ফিশারিঘাটে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে পুরো এলাকা সরগরম। চেনা-অচেনা মাছ দেখতে দেখতে ভিড় পেরিয়ে উঠলাম স্পিডবোটে। গন্তব্য, সাগরবক্ষের দ্বীপ মাতারবাড়ী। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ আর বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশি দেখতে দেখতে কয়েক ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছলাম গন্তব্যে। বোট থেকেই চোখে পড়ল এলাকাজুড়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা ঘিরে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব, শিল্পাঞ্চল এবং সমুদ্রবন্দর তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তারই অংশ এটি। এখানে বাস্তবায়িত হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল সংরক্ষণাগার, বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা, তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) খালাসের টার্মিনালসহ ৬৮টি প্রকল্প। এসব কাজে ব্যয় হতে পারে ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের ২৩টি, জ্বালানি বিভাগের ছয়টি, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) প্রকল্প দুটি, নৌ মন্ত্রণালয়ের ৯টি, সড়ক ও সেতু বিভাগের আটটি, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৯টি করে প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে প্রধান হলো দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর, যা গড়ে উঠছে মাতারবাড়ীতে। গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। সরকার আশা করছে, মহেশখালী ঘিরে চলমান কর্মকাণ্ড শেষ হলে দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যাবে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ঘুরে সেখানকার উন্নয়নযজ্ঞ চোখে পড়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা উন্নয়নের কারণে পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর দিকেও নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এই দ্বীপে বিদ্যুৎ-জ্বালানি হাব হবে। এখান দিয়ে এলএনজি, এলপিজি ও আমদানি করা কয়লা আসবে। একই সঙ্গে এখানে গড়ে তোলা হবে পর্যটন কেন্দ্র।
প্রকল্পের গল্প: জাইকার সহায়তায় মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়লা ও তেল খালাসের জন্য জেটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে যুক্ত হয় গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নের কাজ করছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ। আর বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন দেখভাল করছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি।
মাতারবাড়ীর ধলঘাটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আনুষঙ্গিক বন্দর নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। জাইকা এতে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি তিন লাখ টাকার অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। এ জেটিতে শুধু কয়লা ও তেল খালাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা। এরই মধ্যে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্দরের জন্য চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। আর চ্যানেলের ডান পাশে ১০ কিলোমিটারের কংক্রিটের একটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে চ্যানেলে পলি জমবে না। তবে এই জেটি দিয়ে সাধারণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হবে না। এ জন্য পৃথক গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খরচ পড়বে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান।
গভীর সমুদ্রবন্দরের ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা চ্যানেল তৈরির ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখনই চ্যানেলের গভীরতা ১৬ মিটার। তা সাড়ে ১৮ মিটারে উন্নীত করা হবে। বর্তমানে চ্যানেলে প্রশস্ততা রয়েছে দেড়শ মিটার। মূল সমুদ্রবন্দর নির্মাণ শেষ হলে চ্যানেল আড়াইশ মিটার চওড়া হবে। এ বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্য ঢাকাসহ সারাদেশে নিতে রেললাইন স্থাপন করা হচ্ছে।
তৈরি হবে সড়কও। কক্সবাজার থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সড়ক ও ১৭টি সেতু নির্মাণের কথা রয়েছে। এ বন্দর ২০২৬ সালে চালু হবে। বন্দরের সঙ্গেই ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) গড়ে তোলা হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র-তেল পাইপলাইন: মাতারবাড়ীতে কয়লা, এলএনজিসহ বিভিন্ন জ্বালানির একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে বর্তমানে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক একটি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহেশখালীর মানুষের জীবন চলে মূলত লবণ আর পান চাষ, মাছ শিকার ও শুঁটকি তৈরি করে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে এলাকায় বিদ্যুৎ গেছে, রাস্তাঘাট হয়েছে। পাল্টে গেছে মানুষের জনজীবন। বেড়েছে শিক্ষার হার। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, মহেশখালী মাতারবাড়ীকে গ্রিন ও স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলা হবে মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, সাগরতীরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লি দাঁড়িয়ে গেছে। পাঁচ হাজার বিঘা জমিতে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৩-১৪ সালে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (সিপিজিসিবিএল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন মজুমদার জানান, নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশন কনসোর্টিয়াম ২০১৭ সালের আগস্টে কাজ শুরু করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের ৫৫ ভাগের বেশি কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ৯৫ দশমিক ৮২ শতাংশ মানুষকে এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ইউনিটের কাজ সম্পন্ন হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে একই বছরের জুলাইয়ে।
মহেশখালীর নিকটবর্তী সমুদ্র এলাকায় নির্মিত হচ্ছে বড় জাহাজ থেকে সরাসরি তেল খালাসের পাইপলাইন। জ্বালানি বিভাগের এই প্রকল্প হলো সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন (এসপিএম)। সরেজমিনে দেখা যায়, মহেশখালীর কালারমারছড়াতে পাহাড়ের মধ্যে তেল মজুদের জন্য বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান (বিপিসি) এ বি এম আজাদ বলেন, এসপিএম প্রকল্পটি চালু হলে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে সরকারের। গভীর সমুদ্রে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল খালাসে আর লাইটার জাহাজের প্রয়োজন হবে না। পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় খালাস করা যাবে এক লাখ ২০ হাজার টন তেল। এ পরিমাণ তেল বর্তমানে খালাস করতে অন্তত ১২ দিন সময় প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ টাকার পাশাপাশি সময়ও সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া অবরোধ-নাশকতার আশঙ্কা থাকলে আগে তেল সরবরাহে দেরি হতো, সেটিও ভবিষ্যতে হবে না। বাড়বে জ্বালানি তেলের মজুদক্ষমতাও।
এসপিএম প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শরীফ হাসনাত জানান, ছয় হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার প্রকল্পটির কাজের ৬৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) ও ডিজেল খালাস করা হবে। ট্যাঙ্ক থেকে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে তেল প্রথমে স্থলভাগ ও পরে সমুদ্রভাগের পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের গহিরা ল্যান্ড টার্মিনাল পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে আবার স্থলভাগের পাইপলাইনের মাধ্যমে কর্ণফুলী ইপিজেড হয়ে ডাঙ্গারচর পর্যন্ত এসে কর্ণফুলী নদী অতিক্রম করে ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) ট্যাঙ্কে আসবে জ্বালানি তেল।
এই প্রকল্পে সমুদ্রভাগে ১৩৫ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। নদীর জলভাগে রয়েছে ১১ কিলোমিটার। স্থলভাগের পাইপলাইন ৭৪ কিলোমিটার। এ জন্য ১৮ ইঞ্চি ও ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মিত হচ্ছে।
জ্বালানি হাব: মহেশখালীতে গড়ে উঠছে জ্বালানির বড় হাব। এখানে হবে ভাসমান ও স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল। হবে দেশের সবচেয়ে বড় এলপিজি টার্মিনাল। মহেশখালীর ধরঘাটে দুটি এলএনজি টার্মিনাল হবে স্থলভাগে। এখানকার নিকটবর্তী সমুদ্রে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল হবে। এই তিন টার্মিনাল থেকে দিনে মিলবে ৩৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে স্থলভাগের একটি টার্মিনাল নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এটির জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।
বিপিসির মালিকানায় মাতারবাড়ীর ধলঘাটে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে এ টার্মিনাল নির্মিত হবে। এরই মধ্যে একাধিক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান আগ্রহপত্র জমা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত: মহেশখালী-মাতারবাড়ী ঘিরে সরকারের এই উন্নয়নযজ্ঞকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রকল্প এলাকার পরিবেশ নিয়েও শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তারা।
জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ উন্নয়ন কার্যক্রম ঢাকাকে ঘিরে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে উন্নয়ন-বৈষম্য। সর্বশেষ জরিপে বরিশাল অঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়েনি। এর মানে হলো, সেখান থেকে কর্মের সন্ধানে লোকের স্থানান্তর ঘটেছে। তাই মাতারবাড়ী মহেশখালীকে ঘিরে জ্বালানি-বিদ্যুতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অবকাঠামো উন্নয়ন করে যেভাবে শিল্পায়ন ও সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে এটি হবে দেশের জন্য উন্নয়নের মডেল।
তবে পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যতই আধুনিক হোক, তা কখনোই পরিবেশবান্ধব হবে না। মহেশখালী- মাতারবাড়ীকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্রগুলো সঠিকভাবে নেওয়া হয়নি, ঘাটতি রয়েছে। তেল সরবরাহের এসপিএম প্রকল্পের পাইপলাইন ও মজুদাগার নির্মাণে মহেশখালীর ১৭৫ একর পাহাড় আর সংরক্ষিত বন ধ্বংস হয়েছে। ফলে এসব প্রকল্পের কারণে মহেশখালীর পরিবেশ-প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে।