রাজিক হাসান: ‘সার্ত্রে ভেবেছিলো জীবনটা শব্দের ফাঁদে ধরা পড়বে, আর আমি ভেবেছি শব্দেরা জীবন নয়, পুনর্জীবন’ — ‘সিমন দ্য বোভোয়ার’। জীবনের সঙ্গে শব্দের যে সম্পর্ক, সেটা কী? আমাদের সবার মধ্যে বোধকরি একটা অপ্রকাশের ভার থাকে। নিরন্তর তা বয়ে বেড়াতে হয় আমাদের। আমরা তাই মানুষ খুঁজি, বলতে চাই মনের কথা। বলে ভারমুক্ত হতে চাই, হালকা হই। এমনকি যে মানুষ বিষণ্ন, একাকী অথবা নির্জনতা প্রিয় তারও প্রয়োজন হয় কথা বলার। সে হয়তো নিভৃতি খুঁজে নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। তা যদি নাও হয় গাছেদের সঙ্গে, আকাশের চাঁদ, তারার সঙ্গে কথা বলে। তবু কথা বলা তার চাই। এই যে সুকুমার কলার বিভিন্ন মাধ্যমে দেখি বিচিত্রপন্থায় মানুষ তার নিজের নান্দনিক প্রকাশের এতোসব আয়োজন করেছে তাও কিন্তু এই 'অপ্রকাশের ভার লাঘব করার চেষ্টা থেকে। গল্প-কবিতা বলি, সঙ্গীত বা নৃত্য, চিত্রকলা, এমনকী হাল আমলের ফেসবুকিংয়ে সমস্ত কিছুর মূল উদ্দেশ্য তো একটাই ওগো তোমরা কে কোথায় আছো, শোনো আমার কথা। অনেক কথা বলার আছে আমার। শোনানোর লোক নেই। বলি বটে শোনাতে চাই কিন্তু বলি কী? শোনাতে পারি কী সব কথা?
মনের মানুষ না পেয়ে মনের কথা বলতে না পারার দুঃখ না হয় তোলা থাক কিন্তু আটপৌড়ে সাধারণ যে কথা, বলা কী যায় সব? না, তাও যায়না। মানুষের দুটি প্রাপ্তির কথা ভাবলে সত্যি অবাক হতে হয়। বিস্ময়ও জাগে। এই দুই প্রাপ্তি হলো প্রথমত মানুষ পেয়েছে প্রকৃতি প্রদত্ত এক অদ্ভুৎ দেহ যা শব্দ ধ্বনি সৃষ্টি করতে সক্ষম আর দ্বিতীয়ত মানুষ সৃষ্টি করতে পেরেছে এক বিস্ময়কর মাধ্যম যার নাম শব্দ ‘ভাষা’। চিন্তা করতে সক্ষম মস্তিস্ক শুধু নয় এই দুই আনুসঙ্গিক প্রাপ্তি না ঘটলে মানুষ কী এগোতে পারতো? শব্দহীন বা ভাষাবিহীন বিশ্বের কথা কেউ ভাবতে পারি না আমরা। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন - ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ/ সে তো এল না, যারে সঁপিলাম/ এই প্রাণ মন দেহ’। আরেকটা সক্ষমতা আছে মানুষের, সে কথা লুকোতে পারে। প্রয়োজনে নীরব থাকতে পারে। শব্দ ধ্বনিত হওয়ার বা লেখার আগ পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পারে না কথকের বুকের মধ্যে আর কতো কথা লুকিয়ে আছে। আবার শ্রোতা যদি বক্তার অনুচ্চারিত নীরব কথাও শুনে ফেলতো তাহলে কী কান্ডুটাই না ঘটতো, ভাবা যায়? ফেসবুক থেকে