শুভদীপ চন্দ: কিছু মেয়ে আছে না যাদের সুন্দর দেখাতে সাজতে হয় না। এক গাছি চুল এমনিই বাম কপালে এসে পাক খেয়ে থাকে। অথবা বড় বড় দুই চোখের তারা আকাশের তারার সাথে প্রতিযোগিতা করে। কিংবা অল্প আঁচেই দুই গাল আপেলের মতো লালচে হয়ে যায়। এক অদ্ভুত দীপ্তি পুরো মুখে জুড়ে থাকে। খুঁজতে হয় এ উচ্ছ্বলতার উৎস কোথায়- চোখ না ভঙ্গি! সে এমনি। অন্তত এমনি ছিল বিশ বাইশ বছর আগে। বিশ বাইশ বছর তো কম সময় নয়।
ঈশ্বর মানুষের সময়কে একমুখী করেছেন তবে সাথে এক বরও দিয়েছেন। মানুষ যখন খুশি বিনা যানে অতীতে ফিরে যেতে পারে। সেও পারে। প্রায়ই ফিরে যায় পঁচিশ বছর আগেকার তার পুরনো বাসাটিতে। যেখানে সব সাজ একিরকম। কোনো পরিবর্তন নেই। গেট থেকে ভিতরে দুইপাশে দুই বাগানের মাঝে এক পায়ে হাঁটা পথ। পথের শেষে একতলা বাড়ি। সে বাড়ির তিন চার রুম, বড় খোলা বারান্দা। বারান্দার মেঝের রঙ লাল। দিনেরবেলা সূর্য যখন মধ্য গগনে- টকটক করতো মেঝে।
এক ষোলোগুটির বোর্ড মেঝেতে খোদাই করে আঁকা ছিল। বাবা মা দুই ভাই বোন নিয়ে হাসিখুশি এক পরিবার। সেখানে সে রাজকুমারী। কাঁচের ছোট বলের ভিতরে থাকা মেম প্রিন্সেসের মতো। এ গিফটটা তার বাবা তার ষোলোতম জন্মদিনে দিয়েছিলেন। কোথায় গেল সে সময়? কোথায় হারালো সে বাড়ি? বাড়ির মানুষজন? সে কী এ জন্মের কথা? নিজেকে সে কখনো কখনো আয়নায় দেখে। অকালবৃদ্ধ এ ভারী মহিলার সাথে মেলাতে পারে না সে পুরনো ফর্সা মেয়েটিকে। ঘষা কাঁচের ভেতর থাকা প্রিন্সেসটিও যে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। সর্বশেষ তার বিয়ে উৎসবের কথা তার মনে পড়ে। এরপর শুধু লুকানোর আর লুকিয়ে থাকার গল্প।
আসলে সময় বয়ে চলে না, মানুষই সময়কে রেখে এগিয়ে চলে। কেউ এগোয় বড় পিচঢালা পথ ধরে, কেউ এগোয় এবড়োখেবড়ো বুনো পথ ধরে। স্বামী মারা গেল, ছেলেটাও পড়াশোনা তেমন করলো না। কিছু করবে হয়তো, সে করাটা মুখ উজ্জ্বল করে বলার মতো কিছু হবে না। বাবা মারা গেল, মা বৃদ্ধ হয়ে কোনোরকমে ভাইয়ের সংসারে বেঁচে রইলো। আরেক ভাই বিদেশ থেকে আর ফিরলো না। একা মানুষ সংসার টেনে টেনে হাঁপিয়ে উঠেছে। বয়স যা- এখনো অর্ধেক জীবন বাকি আছে। মাঝেমাঝে তুলনা করে। ভাবে। ঈশ্বর কাউকে বিনা বরে পৃথিবীতে পাঠান না। তাকে হয়তো দীর্ঘায়ুর বর দিয়েছেন।
পরাজিত জীবন নিয়ে বাঁচতে হবে। পরাজয় কখন হয়? এক জীবনকে কখন পরাজিত জীবন বলা চলে? ‘তাহার’ নিজস্ব সঙ্গা হচ্ছে- যখন জীবন অপেক্ষা মৃত্যুই বেশি আপন তখন জীবন পরাজিত। ভাবে- দ্রৌপদীর দুঃখ আরও বেশি ছিল কিনা। যখন পাঁচ বীরকে পতি হিসেবে পেয়েও সৈরন্ধ্রীর কাজ করতে হয়েছিল। সেখানে মহাকাব্যের কবিরা তাকে শেষ অঙ্কে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। অত ভাগ্য তার নেই। ভাবে আর আঁকে। আনমনে এঁকে এঁকে ফুলের পাঁপড়ি গুনে।
বিজোড় হলে খারাপ সময়, জোড় হলে সময় ভালো। যে জীবন যতো নিরলঙ্কার তার হিসেব ততো সহজ। জোড় বিজোড়েই ভাগ্য গননা শেষ। বহুদিন পর কথা হয়। বলে- ‘লিখো না একদিন আমাকে নিয়ে...।’ এক জীবন অসংখ্য মৃত্যুর সমষ্টি। মরছে ধৈর্য, স্বপ্ন, নীতি, আদর্শ, কল্পনা। সবচেয়ে বেশি মরছে ‘সম্পর্ক’। যেকোনো মৃত্যুতেই একটি করে সম্পর্ক মরে যায়। না বনশ্রী, ‘সম্পর্ক’ গাছের শিকড় নয়। সম্পর্ক- ফুল, ফল, গাছের পাতা। শোভাবর্ধক। শুকিয়ে যাবে ঝরে যাবে। তার আগ পর্যন্ত শিকড়কে নাম দিতে থাকবে।
কাল যে ছিল দেবীর আসনে, আজ তার ঠাঁই দেবতার মন্দিরেই নেই। পৃথিবী একবারই বিভক্ত হয়েছিলো সীতার দুঃখে। তারপর সীতাদের চোখের জলে পৃথিবী উর্বরই হয়েছে। কখনো চিড় গ্রস্ত হয়নি। এর মাঝে লুকিয়ে থাকা শিকড় সহজ কিছু নয়। ‘বেঁচে থাকা’ বলতে পারেন। ফেসবুক থেকে।