নিউজ ডেস্ক: দ্রুততম সময়ে মাছ বড় করা বা উৎপাদন বাড়াতে ফিশ ফিডে (মাছের খাদ্য) ভেজালের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব খাদ্য তৈরি কারখানাগুলোর বেশিরভাগই অনুসরণ করে না কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা। শুধু তাই নয় এসব খাদ্যমান নিশ্চিতে নেওয়া হয় না বিএসটিআইর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) সনদ।
এমন পরিস্থিতিতে নিম্নমানের ক্ষতিকর খাদ্যে বড় হচ্ছে মাছ। আর এসব মাছ খেয়ে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিডে থাকা লিড, ক্যাডমিয়াম এবং ক্রোমিয়াম প্রত্যেকটিই ভারি ধাতু। বিশেষ করে লিড এবং ক্রোমিয়াম থেকে ক্যানসার, হৃদরোগ, আলসার, কিডনির অসুখ হতে পারে। মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগের কারণ হতে পারে।
মাছের ভেজাল খাদ্য রোধ কারখানাগুলোতে এক সময় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলত। সিলগালা করা হতো খাদ্য তৈরির কারাখানাগুলো। জেল-জরিমানা করা হতো জড়িতদের। কিন্তু এ মুহূর্তে এসব অভিযান স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চলমান করোনা সংক্রমণে অভিযান একরকম বন্ধই বলা চলে। গত দেড় বছর আগে রাজধানীর ডেমরায় তিনটি কারখানায় অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
ওই সময় ৬ হাজার টন ভেজাল ফিডসহ ১৬ অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। যা সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে ফিশ ফিডের একাধিক নমুনা পরীক্ষা করে সিসাসহ ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। র্যাবের অভিযান বাড়ানো জরুরি বলে উল্লেখ করে মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, মৎস্য অধিদপ্তরের উইং যে অভিযান পরিচালনা করে তা শুধুই নামমাত্র। অধিদপ্তর সূত্র বলছে, লোকবল স্বল্পতা রয়েছে।
তাছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন নিবন্ধিত অনিবন্ধিত কারখানা থেকে ভেজাল ফিড উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১৪ টন। যা প্রতি বছরই জব্দ করা হচ্ছে। প্রায় ১৭ লাখ টাকা জরিমানাসহ ২ হাজার ৪৮৬টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ৩৯১টি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ২৯টি মামলা হয়েছে ফিড কোম্পানির বিরুদ্ধে। লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে ২৮টির।
বারডেমের (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডারস) সাবেক মুখ্য পুষ্টি কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. আখতারুন নাহার আলো বলেন, মাছের খাদ্যে ভেজাল মানেই তা মানবদেহে যাওয়া। কৃত্রিম ফিডে চাষ করা মাছ প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে গিয়ে প্রবেশ করছে মানব শরীরে। ফিডে ভেজাল হলে কিডনি, ফুসফুস, যকৃতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
চাষের মাছ যেহেতু ফিড খাবারে বড় করা হচ্ছে, সেখানে লক্ষ্য রাখতে হবে- কোনো প্রকারেই যেন ভেজাল কিছু না হয়। বিদেশ থেকে যেসব কাঁচা মাল আসছে, সেগুলো কিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে, তা বিশেষ টিমের মাধ্যমে দেখতে হবে। ফিড কারখানাগুলোর বিএসটিআইর অনুমোদন জরুরি। তাহলে যথাযথ মনিটর হবে। বিএসটিআইর সনদ ছাড়া চললে যে কোনো খাদ্যে ভেজাল হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত ২৪৭টি ফিশ মিড তৈরির কারখানা আছে। এছাড়া অনিবন্ধিত-লাইসেন্সবিহীন কারখানা রয়েছে প্রায় ৬ শতাধিকের বেশি। এসব কারখানার কোনোটারই বিএসটিআইর লাইসেন্স নেই। এগুলো বছরে প্রায় ১৮ লাখ টন মাছের খাদ্য উৎপাদন করে। এছাড়া সরাসরি রেডি ফিশ মিড আমদানি করা হচ্ছে প্রায় ২ লাখ টন। বাকি অনিবন্ধিত কারখানায় কী পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে- এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কারও কাছে নেই।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিম বলেন, মৎস্য চাষে বাংলাদেশ যে বিল্পব দেখাচ্ছে বিশ্বে তা প্রশংসিত হচ্ছে। জনগণের নিরাপদ আমিষের জোগান নিশ্চিত করতে দেশের পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতের ওপর নতুন কোনো করারোপ ছাড়াই অনেক নতুন পণ্যের জন্য রেয়াতি হারে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফিড উৎপাদনে ২১টি উপকরণ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফিডের গুণগত মান ও মাছ চাষে আরও স্বচ্ছতা বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নিশ্চয় দেশেই এসব ফিড তৈরির কাঁচামাল হবে। এক সময় হয়তো আর আমদানি করতে হবে না। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হোক, এ বিষয়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে আরও কিভাবে বিষয়গুলো উন্নয়ন করা যায় তা নিয়ে কাজ করব।
ফিড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এতেশাম বি শাহজাহান বলেন, অনিবন্ধিত কিংবা লাইসেন্সবিহীন ফিড কারাখানার জন্য নিবন্ধিত ও লাইসেন্সধারী কারখানাগুলোর দুর্নাম হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই অভিযান হচ্ছে। ভেজাল ফিড উদ্ধারসহ জরিমানা, মামলা হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত ২৪৭টি ফিড কারখানার মধ্যে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনে ৯০টির নিবন্ধন রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধন নয় কিংবা লাইসেন্সবিহীন কারখানাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিন্তু তাদের অপরাধের জন্য আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা স্বচ্ছতার মধ্যে এ ব্যবসা করছি।
তিনি আরও বলেন, আমদানি করা ফিড উপকরণ-ফিশ ফিডের মান যাচাইসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরিতে। যে উপকরণ সমুদ্রপথে আসছে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে মান সম্পূর্ণ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। নির্ধারিত সময়ে মান যাচাই করতে না পারায় মাসের পর মাস বন্দরে উপকরণ পড়ে থাকে। এতে বহু উপকরণ ও ফিড মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। এমন ল্যাব আরও অন্তত ৫-৭টি প্রয়োজন। বিএসটিআই সনদ বিষয়ে তিনি জানান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নির্দেশনা ও বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী আমাদের কারখানাগুলো নিবন্ধিত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত। আমরা দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স কিংবা সনদ নিতে পারি না, এটি হওয়ারও কথা নয়। এ বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান। নিশ্চয়ই এর একটি সঠিক সমাধান পাওয়া যাবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ফিশ ফিড তৈরির উপকরণের মধ্যে ৯টি সরাসরি কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ১১টি উপকরণে আছে ভিটামিন, প্রোটিন ও পানি বিশুদ্ধকরণ উপাদান। মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মৎস্য চাষ এখন এক প্রতিযোগিতার নাম। এটা নিশ্চয় ভালো। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। কিন্তু, চাষের মাছে যেন যথাযথ খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়। গ্রাম থেকে ইউনিয়ম পর্যায়ে অনেকেই অপরিকল্পিতভাবে চাষ করা মাছে নিয়ম ভঙ্গ করে খাবার দিচ্ছেন। কোথাও আবার মরা গবাদি পশু ও মুরগি এবং মুরগির বিষ্ঠা ও আবর্জনা খাওয়ানো হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে তৈরি মাছের ফিড পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ মান যাচাইয়ে ঢাকার সাভার, খুলনা ও চট্টগ্রামে তিনটি কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি রয়েছে। মূলত এ তিনটি ল্যাবে রপ্তানি করা মাছের মান যাচাইসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু আমদানি করা ফিশ ফিড কিংবা ফিড তৈরির উপকরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা মান যাচাইয়ে আলাদা কোনো ল্যাবরেটরি নেই। ফলে নির্বিঘ্নে ভেজাল ফিড তৈরি হচ্ছে- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সাভারে থাকা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ বরকতউল আলম জানান, তিনটি ল্যাব মৎস্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব ল্যাবে মূলত রপ্তানি করা মাছের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কোয়ালিটি পরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া দেশের সবকটি উপজেলা থেকে ফিশ ফিড তৈরির স্যাম্পল আসছে। বাধ্য হয়ে এসব ল্যাবে ফিডের কোয়ালিটিও টেস্ট করা হচ্ছে। বছরে প্রায় ১৬শ স্যাম্পল আসে। একেকটি স্যাম্পল টেস্ট করতে ৮-৯ ঘণ্টা সময় লাগে। এসব টেস্ট করতে বহু সময় লাগায়, উপজেলা থেকে আসা স্যাম্পল টেস্ট করে ফলাফল পাঠাতে মাসের পর মাস সময় লেগে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. জুয়েল শেখ দাবি করে বলেন, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ৪৮৭টি উপজেলায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা ফিডের গুণগতমানও দেখছেন। চাষ মাছে নির্ধারিত খাদ্য, ওষুধ প্রয়োগের নির্দেশনা রয়েছে। পুকুর কিংবা জলাশয়ে কি পরিমাণ পানিতে কি পরিমাণ মাছ চাষ করতে হবে, তার সম্পূর্ণ গাইডলাইন দেওয়া আছে। চাষের মাছে বছরে প্রায় ১৯ থেকে ২০ লাখ টন খাবার (ফিশ ফিড) লাগে। চিংড়ি মাছের ফিড সম্পূর্ণ রেডিমিড আমদানি করা হয়। অধিকাংশ ফিড তৈরি হচ্ছে দেশীয় কাঁচামালে।
বিএসটিআইর পরিচালক সার্টিফিকেশন মার্কস উইং (সিএম) মো. নুরুল আমিন জানান, মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক ২৫০টি ফিশ ফিড কারখানার যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর কোনোটারই অনুমোদন-লাইসেন্স নেই বিএসটিআইয়ের। এসব কারখানার কোনো খাবারেই বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদন নেই। সরকারের নির্দেশনা রয়েছে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব কারখানা বিএসটিআইর নিয়ন্ত্রণে আনতে। বিএসটিআই থেকে বেশ কয়েকবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চিঠিও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অদ্যাবধি উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে এসব কারখানা কোনো নিয়মে চলছে- তার কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই বিএসটিআইতে।
মো. নুরুল আমিন জানান, মাছের যে সব খাদ্য বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হচ্ছে কিংবা কাঁচামাল আমদানি করা হচ্ছে সেগুলোয় বিএসটিআই কিছু করতে পারছে না। ইতোমধ্যে আমাদের সব অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব কারখানাগুলো লাইসেন্সের আওতায় আনার। আমরা যদি লাইসেন্স ও অনুমোদন দিতে পারি, তাহলে আমাদের মনিটরিংয়ে থাকবে। এসব কারখানা কিংবা ফিশ ফিড উৎপাদন ও আমদানিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে বিএসটিআই। যতক্ষণ না আমরা এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব- ততক্ষণ তো আমরা মনিটরিং করতে পারছি না।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত কয়েক বছর আগে একাধিক অভিযানে মাছ ও পোলট্রি ফিড কারখানায় অভিযান চালিয়ে ভেজাল ফিড উদ্ধারসহ অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে কারখানা সিলগালাসহ সংশ্লিষ্টদের বিপুল অর্থ জরিমানা করা হয়। আমরা ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়মিতই করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. নীলুফার নাহার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগ ট্যানারির বর্জ্যে পোলট্রি ও মাছের ফিড তৈরি নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ফিডে ট্যানারি বর্জ্য থাকায় মাছ ও ফার্মের মাংসে অতি মাত্রায় ক্রোমিয়াম রয়েছে। যদি ফিডে ট্যানারি বর্জ্য এবং ভেজাল ফিড তৈরি হয় তা মানবদেহের জন্য ভয়ানক। সূত্র: যুগান্তর