রবিউল আলম: গোপালগঞ্জ থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর। বাংলার গণজাগরণের পেছনে, জাতির জনকের রাজনৈতিক জীবনে, বাংলার মুক্তির সংগ্রামে, জীবনের সুখ-স্বাছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে যে নারী বঙ্গমাতার উপাধী অর্জন করেছেন, তিনি জাতির জনকের সহধর্মীনি বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মাত্র ছয় বছর বয়সে সংসার জীবনে করেন তিনি। খেলার ছলে শ^শুর-শ^াশুরীর ছায়াতলে বেড়ে ওঠা বাঙালির জীবনধারাকে সম্মানের সহিত গ্রহণ করা, স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের সকল যন্ত্রণাকে নীরবে বুকে ধারণ করে রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়া। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখা একজন নারীর পক্ষে সহজ ছিলো না।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ফার্স্টলেডি বেগম মুজিবকে দেখেছি অতি সাধারণ একটি কাপড়ে। বাঙালি নারী, কৃষকের বধূ ও মমতাময়ী মায়ের রূপে। কাঁচামরিচ, লাউ-কুমড়া, হাঁস-মুরগি, কবুতর ও গরু পালন করা হতো ৩২ নম্বরে। এখনো কবুতর ও পাকের ঘর সংরক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাড়ি থেকে লেকের পাড়ের ফেরিওয়ালাদের খাবার পানি আনার দৃশ্যধারণ করেছি এই অন্তরে। এখন কল্পনার অতীত। জল চৌকির ওপর বসে রান্নার আয়োজন, প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় কাজে, নারীর অসহায়ত্বে সাহায্য ও মানুষের সহায়তার তালিকা নির্ধারণ। দেখেছি বেগম খালেদা জিয়াকে, তার দ্বিতীয় সংসার জীবন রক্ষার আবেদন নিয়ে পাকের ঘরে হাজির হতে। বাংলার আনাচে-কানাচের পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা নারীদের আর্তনাদ, বেগম মুজিবের অসামান্য অবদানের চিত্র ধারণ করেছি এই মনের আয়নায়। জাতির জনকের রত্নগর্ভা মায়ের ছোঁয়ায় ৬ বছরের বেগম মুজিব একদিন হাসুর মা হয়ে উঠেছিলেন। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের মা হয়েও বাঙালি জাতির কাছে তিনি বঙ্গমাতা। এই উপাধি কারও দয়ার দানে পাওয়া নয়, অর্জন করতে হয়েছে জাতির মন জয়ের মাধ্যমে।
আমার জীবনের একটি ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে বেগম মুজিবকে আবিষ্কার করতে চাই। সত্তর সালের নির্বাচনে নৌকার মিছিলে তৎকালীন সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসিরউল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে রায়েরবাজার থেকে যাত্রা শুরু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের উদ্দেশে। হাইস্কুল ট্যানারি মোর, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাবেটরী, কলাবাগান, শুক্রাবাদ হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে দিয়ে ৮ নম্বর ব্রিজ হয়ে আবহানী ক্লাব মাঠে মিছিলের পরিসমাপ্তি হয়েছিলো। সকালে মিছিলের আয়োজন হলেও ১০টা পর্যন্ত একজন মাঝির অপেক্ষায় মিছিল শুরু হচ্ছিলো না। বিশাল আকৃতির একটি নৌকা, কাগজ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ঠেলাগাড়ির ওপর উঠিয়ে নাসিরউল্লাহ সাহেব, রমিজ চাচা, নাদের খান, বর্তমান এমপি আলহাজ্ব মো. সাদেক খান, গফুর ভাই, খোরশেদ আলম, বাচ্চু, বুলবুল, মুনসুর কোম্পানি সহ শতশত মানুষ অপেক্ষায়। জনতার সারিতে আমিও ছিলাম। রশিদ চাচা আমাকে ধরে নিয়ে তুলো দিয়ে দাঁড়ি-গোফ বানিয়ে হুক্কা হাতে দিয়ে নৌকার মাঝি করা হলো। ব্যান্ড পাটিতে ‘জয় বাংলার জয়, হবে নৌকার জয়’ মিছিল এগিয়ে চলছে। ৩২ নম্বর আসতেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অপরপ্রান্ত আমার নৌকার ঠেলাগাড়ি থেমে গেলো। রমিজ চাচা, নাসিরউল্লাহ সাহেব গাড়ির দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব বাড়ির ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। মিছিল এগিয়ে চলছে, ব্যান্ডের তালে তালে আমার শরীরের নানা অঙ্গভঙ্গি ও হুক্কার টানে কখনো মুজিবকে আকর্ষণ করেছিলো, বুঝতে পারিনি। একপলকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মিছিল শেষ হতেই রমিজ চাচাকে হুকুম দিলেন, ওই ছেলেটাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আয়। তখনো আমার শরীরের অঙ্গভঙ্গি থামানো যায়নি। মুজিবের ভারী কণ্ঠ, ‘হাসুর মা, ছেলেটাকে একগ্লাস দুধ দিও’। বেগম মুজিব স্বস্নেহে দুধ নিয়ে হাজির। আমি কিছুতেই দুধ খাবো না, অনেকেই চেষ্টা করলেন, ধমক দিলেন। কোনো কাজ না হওয়ায় শেখ মুজিব আবারও গর্জে উঠলেন। ‘আরে তোরা নেতাগিরি করবি কেমনে, মানুষের মনের কথা বুঝতে না পারলে। ওর দাঁড়ি-গোফ খুলে দে, এমনিতেই খাইবো। কথামতো আমার দাঁড়ি-গোফ খুলতেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
বেগম মুজিব হাসতে হাসতে দুধ নিয়ে আমার সামনে হাজির হলেন, দুধ খাইলে দাড়ি-গোফ আবারও লাগিয়ে দেওয়া হবে। একটানে দুধ খেলাম, আমার দাঁড়ি-গোফ লাগানো হলো। আমি আমার আপন ভুবনে, অট্টহাসিতে বঙ্গবন্ধুর ভবন। এখনো সেই ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পরে ব্যালকুনি, বাঙালির অর্জিত সেই অসাধারণ মানুষ দুইটি চোখে পড়ে না। চোখে জল আসে ভাবলে। ৫ আগস্ট শেখ কামালে জন্মদিন, ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন, ১৫ আগস্ট মৃত্যুবার্ষিকী। মনের আয়নায় বেদনার প্রতিচ্ছবি, বাংলার মায়াময় একজন নারীর আচলের ছায়া হারিয়েছে বাঙালি। কৃতজ্ঞচিত্তে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে আমরা স্মরণ করছি, করবো এ দেহে যতোদিন প্রাণ আছে। আমরা অনেকেই রাজনীতির কথা বলি, ত্যাগের কথা বলি। বলি সততার কথা, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবের কথা। ১৫ ও ২১ আগস্টের জীবনদানকারী ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের হিসেব করলে, মনে হয় আমরাই লাভবান হয়েছি একটি স্বাধীন জীবনের অধিকারী হয়ে। রাজনীতিতে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব যারা করেন, তারা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবন থেকে কিছু নিতে পেরেছেন? মানুষকে ও দেশকে ভালোবেসে যারা অকাতরে জীবনদান করেছেন, তাদের জন্য কিছু করতে পেরেছেন? নাকি হেলেনা জাহাঙ্গীর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর?
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি