নিউজ ডেস্ক: দেশী উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত করে দিতে নতুন নীতিমালা করছে সরকার। এজন্য ‘বহির্বিশ্বে বাংলাদেশী বিনিয়োগ নীতিমালা ২০২১’ শিরোনামে একটি খসড়াও এরই মধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। খসড়া এখন চূড়ান্ত মতামত গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
দেশের ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ বেশ পুরনো। সরকারের অনুমোদনের ভিত্তিতে এরই মধ্যে বেশকিছু কোম্পানি বহির্বিশ্বে বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। তবে এসব অনুমোদনের প্রতিটিই দেয়া হয়েছে কেস টু কেস ভিত্তিতে। বর্তমানে গোটা বিষয়টিকে সাধারণ একটি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসতে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
খসড়া নীতিমালায় বিদেশে বিনিয়োগের ন্যূনতম আর্থিক যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, টানা পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী অনুযায়ী কোম্পানির নিট মূলধন হতে হবে অন্তত ৫০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ। আর্থিক যোগ্যতার এ মাপকাঠি পূরণ না হলে বিদেশে বিনিয়োগ করা যাবে না।
বিডা সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নের পর এ বিষয়ে মতামতের জন্য অংশীজনদের নিয়ে একটি কর্মশালা করা হয়েছিল। কর্মশালায় তাদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত নতুন এ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর খসড়া নীতিমালাটি আবারো তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের আর কোনো মতামত থাকলে তা খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এরপর এ খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাবে বিডা। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। মন্ত্রিপরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে এটি কার্যকরের জন্য গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশী বিনিয়োগ-সংক্রান্ত নীতিমালা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। নীতিমালার খসড়ায় প্রস্তাবিত অনেক বিষয়ই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এটি চূড়ান্ত হলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হবে এবং বাংলাদেশের নতুন পরিচয় বা ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া মতামতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে দুটি বিষয়। একটি হলো বহির্বিশ্বে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক যোগ্যতা। আরেকটি হলো বিনিয়োগ, মূলধন ও লভ্যাংশ ফেরত বা প্রত্যাবাসনের পদ্ধতি। এছাড়া অংশীজনরা প্রবাসীদের বিনিয়োগ আগ্রহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেও নীতিমালাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ করার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
নীতিমালায় আবেদনকারী কোম্পানির আর্থিক যোগ্যতা হিসেবে ৫০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ নিট মূলধনের বাধ্যবাধকতা রাখা হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ছাড় দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যাংক সচ্ছলতা সনদের ভিত্তিতে অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিদেশে বিনিয়োগে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট খাতে কমপক্ষে তিন বছরের ব্যবসা বা উৎপাদনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর বিবরণী অনুযায়ী কমপক্ষে দুই বছর লাভজনক হতে হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে যৌক্তিক ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি শিথিল করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গন্তব্য দেশের বিধিবিধান মেনে সেখানকার পুঁজিবাজারেও তালিকাভুক্ত হতে পারবে বলে খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে।
বিদেশে বিনিয়োগের ভিত্তিতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে দেশে মূল প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারবে। এছাড়া দেশে বা বিনিয়োগ গন্তব্যে অবস্থিত ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রয়োজনে ঋণ নেয়া যাবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ঋণ ও মূলধনের অনুপাত হতে হবে ৭০: ৩০। বিদেশে বিনিয়োগকৃত প্রকল্পে অর্থায়নের বিপরীতে দেশের করপোরেট বা ব্যক্তিগত অথবা অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তির গ্যারান্টি ব্যবহার করা যাবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। তবে ভুল পদ্ধতি ও খাতে বিনিয়োগ করা হলে তা দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষতি বা অপচয়ের কারণ হতে পারে। এমনকি সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
নীতিমালার চলতি হিসাব লেনদেন-সংক্রান্ত পদ্ধতিগত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ হবে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৭ ও মূলধনি হিসাবে লেনদেন বিধিমালা ২০২১-এর মাধ্যমে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি ও সুনীল অর্থনীতি (ব্লু ইকোনমি) বেগবান হতে পারে এমন দেশ গন্তব্য হিসেবে প্রাধান্য পাবে। তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন কোনো দেশে বাংলাদেশী বিনিয়োগ করা যাবে না। এছাড়া বাংলাদেশ ও গন্তব্য দেশের আইনকানুন এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রটোকলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেকোনো বিনিয়োগের অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ এবং পরিবেশ বিধ্বংসী ও দূষণমূলক কোনো কার্যক্রমেও বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হবে না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিডা বলছে, রফতানি সংরক্ষণ কোটা সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদনের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান আগের পাঁচ বছরের গড় রফতানি মূল্যের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে রফতানিকারক নয় এমন প্রতিষ্ঠানেরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিকে দেশে আগের ১০ বছর ধরে সফলভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হতে হবে। এছাড়া গন্তব্য দেশের স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে অগ্রবর্তী বা পশ্চাত্সংযোগ (ফরোয়ার্ড বা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) শিল্প স্থাপনে সক্ষম আগ্রহী প্রতিষ্ঠানও বিদেশে বিনিয়োগের আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ নিরীক্ষিত ব্যালান্স শিট অনুযায়ী নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগ করা যাবে।
তবে বহির্বিশ্বে বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা বলছেন, খসড়া নীতিমালাটি এখনো পুরোপুরি সহজ ও স্বস্তিকর হয়ে ওঠেনি। বেশকিছু ধারা আছে, যেগুলো বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। এসব ধারার মধ্যে আছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার রূপরেখা ও বিদেশের মাটিতে লাভ করে দেশে ফিরিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা। এ ধরনের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মতামত নীতিমালায় যথাযথভাবে প্রতিফলিত না হলে নীতিমালাটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
অংশীজন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব নীতিমালায় নির্ধারিত পুঁজি ও লভ্যাংশের অর্থ প্রত্যাবাসনের সময়সীমা অতিক্রম হলে তা মুদ্রা পাচার হিসেবে গণ্য করা হবে। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে আজাদ বলেন, নীতিমালায় বলা আছে, বিদেশে বিনিয়োগ করে যদি অর্থ ফেরত আনতে না পারি তা মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ব্যবসায় লাভ-লোকসান স্বাভাবিক বিষয়। সবসময় ব্যবসায় লাভ হবে এমনটা ধরে নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আবার বলা হয়েছে, বিদেশে বিনিয়োগ করে সেখানকার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। যদি কোনো কারণে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে কী হবে? এমন অনেক জটিল কিছু বিষয় আছে, যেগুলো সমাধান করতে না পারলে এটি কাগজে-কলমে নীতিমালা হিসেবেই থেকে যাবে। কোনো কার্যকর ফল আসবে না। আমরা মতামত দিয়েছি। সেগুলোর ভিত্তিতে যদি নীতিমালা করা হয়, তাহলেই বিদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাবেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরো বলেন, বিডা যে নীতিমালাটি করছে, সেটি অনেক জটিল করে ফেলেছে। প্রতিবেশী দেশ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সহজ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে বিদেশে বিনিয়োগ করা যাবে না। আর বিদেশে বিনিয়োগ করতে না পারলে আমাদের দেশীয় বিনিয়োগ বাড়বে না। আমাদের কাস্টমাররা যারা পোশাক কিনছেন আমাদের কাছ থেকে তারা এখন দেখছেন, বাংলাদেশে যারা বড় রফতানিকারক বা বড় ব্যবসা করে, তৃতীয় কোনো দেশে তাদের কোনো বিনিয়োগ আছে কিনা। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের প্রত্যাশা বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারলে পুঁজিসহ লভ্যাংশ দেশে নিয়ে আসতে পারব। আর এ প্রত্যাশা বাস্তবে রূপ দিতে যে নীতিকাঠামো হচ্ছে সেটি সবার জন্য স্বস্তিদায়ক হতে হবে।
নীতিমালায় বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীরা বহির্বিশ্বে বিনিয়োগের জন্য যে খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে পারবেন, সেগুলোরও একটি রূপরেখা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষিসহ অগ্রাধিকার পাওয়া খাত হিসেবে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি, হালকা প্রকৌশল, খাদ্য তৈরি ও প্রক্রিয়াকরণ, সেবা, চামড়া, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য ও ওষুধ শিল্প।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, নীতিমালাটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এটা আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি যে বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের ওভারসিজ ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ থাকা উচিত। বাজার অর্থনীতি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেশী অনেক দেশের বিনিয়োগ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। বর্তমানে আমাদের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ভালো। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন নীতিমালাটি হলে বিনিয়োগকারীরা অন্তত জানতে পারবেন কোথায় কীভাবে কত বিনিয়োগ করা যাবে। ফলে নীতিমালার ধারণাটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। খসড়াটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়েই নীতিমালাটি চূড়ান্ত হবে বলে মনে করছি। - বণিক বার্তা