আতিকুজ্জামান ফিলিপ: মানুষ যখন আদিম অসভ্য ছিলো তখনো মারামারি খুনখারাবি হতো, এখনো হয়। সব দেশেই হয়, সব কালেই হয়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মারামারি খুনখারাবি হয়। হয়তো ঘটনার কারণ ও ধরন বিচারে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। একইভাবে আমাদের দেশের সকল জেলাতেই কমবেশি মারামারি খুনখারাবি হয় এবং এখানেও বিভিন্ন জেলার এসব ঘটনার কারণ ও ধরনে পার্থক্য থাকে, থাকে বৈচিত্র্য। হালে করে আমাদের দেশের একটি বিশেষ জেলার নাম প্রায় প্রায়ই মিডিয়ায় আসছে যেখানে আমরা দেখছি অত্যন্ত সিলি কারণে সেখানকার লোকেরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পুরো গ্রাম জুড়ে মধ্যযুগীয় অস্ত্রসস্ত্র ঢাল-তলোয়ার টেটা, বল্লম নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে নামছে! যেকোনো ঠুনকো অজুহাতে তাদের এমন যুদ্ধের ইতিবৃত্ত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে খোদ প্রশাসন পর্যন্ত নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমরা দেখেছি সুদূর ব্রাজিলে কোপা এমেরিকার ফাইনাল চললেও বাটারফ্লাই ইফেক্টের মতো তার ঢেউ সেই বিশেষ জেলাতে আছড়ে পড়ে সেখানে মারামারি খুনখারাবি হতে পারে এমন আশঙ্কায় সেখানকার প্রশাসনকে বাড়তি সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। সেই বিশেষ জেলাকে যে মিছেই এমন স্টিগমাটাইজ করা হয়েছে এবং এর যে কোনোই সারবত্তা নেই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার তথ্য অন্তত সেরকম বলে না। বাস্তবিক অর্থেও প্রায়ই আমরা বিভিন্ন দৈনিকের প্রথম পাতায় মধ্যযুগীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সেখানকার বিভিন্ন যুদ্ধের সচিত্র প্রতিবেদন দেখি। তো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এই বিশেষ জেলার এমন তুঘলকী যুদ্ধকে নিয়ে যখন নেটিজেনরা স্যোশাল মিডিয়ায় ট্রল করে তখন সেই জেলার লোকেরা ব্যাথিত হন। আমরা যারা ট্রল করি তাদের ওপর তারা ক্ষিপ্ত হন। তারা বলতে চান, দেশের সবখানে সব জেলাতেই মারামারি খুনখারাবি হয় তাহলে শুধু আমাদের জেলাকে নিয়েই কেন এমন ট্রল করা হবে!? তারা বলতে চান তাদের জেলাকে নিয়ে এটা মিডিয়ার বাড়াবাড়ি, হাইপ তৈরি করে টিআরপি কামানোর কারসাজি! বলে রাখা ভালো আমার জেলা যশোরও একসময় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য ছিলো। ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন দেখেছি মাস্তানেরা দিনের আলোয় খোলা রাস্তা দিয়ে হকিস্টিক, রামদা, চাইনিজ কুড়োল, ক্রিজ, ত্রি নট ত্রি, শটগান নিয়ে এপাড়া থেকে ওপাড়ায় মারামারি করতে ছুটছে! সেই শৈশবে এলাকার বড় ভাইদের কাছ থেকে কৌতুহলবশত নাইন এম এম পেট্রো বেরাটা আমরাও ছুয়ে দেখেছি!
বস্তুত যশোরের ছেলেদের জন্য একসময় এগুলো ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার কিন্তু আজ সেগুলো একেবারেই ইতিহাস হয়ে গেছে, সত্যিকারার্থেই ইতিহাস হয়ে গেছে। যশোরের মতো দেশের অন্যান্য জেলাতেও একসময় কমবেশি এমন দাঙ্গাফ্যাসাদ হতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না যেমনটা হতো তিন/চার দশক আগে। অন্যান্য জেলাগুলোতে কিছু মারামারি খুনখারাবি হলেও সেগুলো নিতান্তই অল্পকিছু লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, পুরো এলাকা বা পুরো গ্রামজুড়েই এবং পুরো গ্রামবাসীই সেই মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে না। সেই মারামারি খুনখানাবিগুলো ওই বিশেষ জেলার মতো এমন কোনো তুচ্ছ কারণে হয় না যেগুলো আলোচনার মাধ্যমেই এলাকার সিনিয়র ভাই বা মুরুব্বি বা রাজনৈতিক নেতারা সমাধান করে ফেলতে পারতো এবং সেই মারামারি খুনখারাবিগুলো ওই বিশেষ জেলার মতো মধ্যযুগীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুরো গ্রামজুড়ে হয় না। যাইহোক, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই বিশেষ জেলাকে নিয়ে ট্রলের কারণে সেই বিশেষ জেলার যারা ক্ষুব্ধ হন তাদের আমি স্যালুট জানাই। নিজ জেলার প্রতি তাদের এই ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করি।
বস্তুত যে মানুষ নিজের জন্মস্থানকে ভালোবাসতে জানে না, নিজের এলাকা বা জেলাকে ভালোবাসতে পারে না, নিজ দেশের প্রতিও তার ভালোবাসা জন্মে না। দেশপ্রেম বিষয়টি এমনই। আমার আপনার ক্ষেত্রেও সেটা এমনই। যেহেতু সেই বিশেষ জেলাটি আমার দেশের বাইরে না, তাই সেই বিশেষ জেলার এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিয়ে যখন ট্রল করা হয় তখন তার মানে এমন নয় যে সেই বিশেষ জেলাকে বা সেই বিশেষ জেলার সকল সাধারণ নাগরিককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে, আমি অন্তত সেরকমই মনে করি। আমি মনে করি, সেই জেলাকে বা সেই জেলার সকল মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে সেটা আমার ওপর দিয়েও যায়। কারণ সেই জেলাটি আমার দেশের মধ্যেই অবস্থান করে এবং সেই জেলার সকল নাগরিক আমার দেশেরই নাগরিক। তারপরেও কেন ট্রল করি? ট্রল করি সেইসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় জড়িত গোয়ার লোকগুলোর ওপর বিরক্ত হয়ে। এই অল্পকিছু গোয়ার অসভ্য লোকের কারণে পুরো জেলার মানুষকে প্রায়ই উপহাসের পাত্র হতে হয় (অন্তত তারা তেমনই মনে করেন)। সেই বিশেষ জেলার যারা ট্রলকারীদের ওপর ক্ষুব্ধ হন তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ রেখে বলতে চাই, আপনারা যদি মনে করেন প্রায় প্রতিনিয়তই এমন কোনো ঘটনা আপনাদের জেলায় ঘটেনা তাহলে ওইসব ঘটনার ছবি বা ভিডিও গুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করে মিডিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। অথবা যদি মনে করেন দেশের অন্যান্য জেলাতেও এখনও এমন তুচ্ছ কারণে পুরো গ্রামজুড়ে যুদ্ধ হয় তাহলে সেগুলোর তথ্য ও ছবি তুলে হাজির করুন। তাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক হয়ে যথাযথ ব্যাবস্থা নিতে পারবে। আর যদি মনে করেন ওপরের দুটি কাজের একটিও করা সম্ভব নয় তাহলে বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজ এলাকায় গিয়ে সমাজের শিক্ষিত যুবক ও গণ্যমান্য মুরুব্বিদের নিয়ে প্রবল একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন যার দ্বারা আপনার জেলার ওই গোয়ার লোকগুলো মোটিভেটেড হয়ে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত দাঙ্গাফ্যাসাদ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবে এবং আপনাদেরও প্রতিনিয়ত বিব্রত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। মনে রাখবেন, এতে করে যে শুধু আপনারাই রক্ষা পাবেন তা নয়, বরং আমরা পুরো দেশের মানুষই প্রতিনিয়ত এমন বিব্রত হওয়া থেকে রক্ষা পাবো। ফেসবুক থেকে