শারফিন শাহ: হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ছবিটিতে ওঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন একদল বিপন্ন মানুষের অনিশ্চিত যাত্রা। যারা এই নৌকায় ঠাঁই পেয়েছেন তাদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে। উঁচু-নীচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড়, সভ্য-অসভ্যসহ নানান রকম মানুষের সংকটময় পরিস্থিতি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা। মানবিক বিপর্যয় বা যুদ্ধ যে সর্বস্তরের মানুষের জন্য বিপদ সংকেত নিয়ে আসে, ‘শ্যামল ছায়া’ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ছবিটি আবেগমণ্ডিত হওয়ায় কোনো কোনো দৃশ্যে চোখ না ভিজে পারে না।
তবে এই ছবিতে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে ধর্মের ব্যবহারটাই প্রধান হয়ে ওঠেছে। ধর্মীয় সংঘাতের তুলনায় সম্প্রীতির মিলনসূত্র পাওয়া যায় ছবির অনেকগুলো দৃশ্যে। মাওলানা চরিত্রে অভিনয় করা রিয়াজ গোঁড়ামিপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নন। তিনি খুবই উদার প্রকৃতির। নৌকার মালিক যখন একটি হিন্দু পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে নৌকায় তুলতে চান না, তখন মাওলানা বলেন, ‘বিপদের সময় আমরা যদি একে অপরকে সাহায্য না করি তবে আল্লাহ পাক নারাজ হন, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন...’ কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বোঝাতে চান, ‘ধর্মের চেয়ে মানুষের জীবন মূল্যবান’। নৌকায় একদিকে চলে পূজা আরেক দিকে নামাজ। তবে নৌকার মালিক এতো আয়োজন করে পূজা করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকার ভয়ে পূজার উপকরণগুলো ফেলে দিতে বলেন। এতেও মাওলানা সাহেব বাধা দেন। মাওলানার স্ত্রী মুখসহ বোরকাবৃত। পুরো ছবিতে একবার মাত্র মুখ খুলেন। তবুও হিন্দু ঘরের বউ শাওনের সঙ্গে তার সখ্য। নৌকা নষ্ট হলে যখন সবাই ডাঙায় তখন রান্না করা হয়। হিন্দু আহমেদ রুবেল নিজের রান্না করা খাবার কোরআন শরিফ পড়ারত মাওলানার স্ত্রীকে দিতে গেলে তিনি রোজা রাখার কথা জানান। আহমেদ রুবেল তার কোরআন শরিফ পড়ার সুবিধার জন্য একটা ছাতা এনে গেঁথে দেন মাথার ওপর। এই দৃশ্যের সমান্তরালে আবার শাওনের স্বামীকে দেখা যায় নদীতে নেমে ধর্মীয় শ্লোক সহযোগে পুণ্যস্নান করতে! নৌকায় রাজাকার কমান্ডার আক্রমণ করলেও মাওলানা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিহত করেন। অথচ তিনি তখনো পাকিস্তানের সমর্থক। একসময় মাওলানা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ওদের নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেন। তারপর তিনি অনুতপ্ত হয়ে বলেন, ‘ওরা জালিম, ওরা জালিম!’
ছবির সবচেয়ে নান্দনিক পর্বটি হুমায়ুন ফরীদির গানের দলের। গানের দল হিসেবে তারা নৌকায় ওঠেন। কিন্তু একসময় প্রমাণিত হয় ফরীদি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। সবাই তাকে সালাম দেয়, শ্রদ্ধার চোখে তাকায়। ফরীদি নিজেও বাস্তবে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যেন সেই একাত্তরের রক্ত হিম করা দৃশ্যপট তিনি অল্পতেই ফুটিয়ে তুললেন। তিনি গান গাইলেও ধর্মপ্রাণ। তাই মিলিটারির গুলিতে যখন শাওন মৃত্যুমুখী তখন তিনি দুহাত তুলে আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করেন। হিন্দু নারীর জন্য মুসলমান দোয়া করছেন আল্লাহর কাছে, এমন দৃৃশ্য বাংলা আর কোনো ছবিতে দেখা যায়নি বলেই বিশ্বাস। সবশেষে একটি পাকিস্তানি নৌকা উড়িয়ে হুমায়ুন ফরীদি যখন চলে যাচ্ছেন তখন তার সাথে যুদ্ধে যেতে চান মাওলানা সাহেব। তিনি বলেন, ‘একজন খাঁটি মুসলমান জালিমের শাসনে থাকতে পারেন না।’ হুমায়ুন ফরীদি বলেন, ‘গান জানেন?’ মাওলানা বললেন, ‘টুকটাক জানি, তবে শিস বাজাতে পারি!’ মাওলানা শিস বাজাতে বাজাতে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছেন এমন দৃশ্যও আর কোনো ছবিতে দেখা যায়নি।
হুমায়ূন আহমেদের গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছবিতে এভাবেই ধর্মীয় বিষয়কে উদারতা ও স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে দেখানো হয়েছে। সবাই যার যার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা পেয়েছে। এমনকি যিনি মুসলমান তিনিও ধর্মীয় বিধির বাইরে এসে স্বাধীনতা পেয়েছেন। এই ছবির একটি দৃশ্যে ডা. এজাজুল ইসলামকে মাওলানা রিয়াজ বলেন, ‘ভাই এইগুলো কী খান?’ এজাজ বলেন, ‘শরাব খাইতেছি, দোজখে আমি যাবো, কোনো সমস্যা’! এরকম দৃশ্যও আমাদের ছবিতে বিরল।
২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। সেই সময় হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে শেখ মুজিবের ভাষণ ও আওয়ামী লীগের কথাও এনেছেন এবং সেটা তিনি করেছেন সুকৌশলে একজন মাওলানাকে ব্যবহার করে। লেখক ও নির্মাতা বহু আছেন, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মতো বুদ্ধিমান ও কৌশলী খুব কম। তিনি আসলেই একজন জাদুকর ছিলেন। প্রয়াণ দিবসে তার প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :