নিউজ ডেস্ক: একদিকে করোনা, অন্যদিকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ধাক্কা—দুই মিলিয়ে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বিপর্যয় নেমেছিল ২০২০ সালের প্রথমার্ধে। যদিও বছর শেষে সে বিপর্যয় কিছুটা পুষিয়ে নিয়েছিল ব্যাংকগুলো। তবে নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা না কমলেও চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেশের ব্যাংক খাত বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশও ছাড়িয়েছে।
বরাবরের মতোই এবারো দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথমার্ধে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল, এক্সিম, এনসিসি, ঢাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী, যমুনা, এসআইবিএল ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গতকাল পর্যন্ত নিজেদের অর্ধবার্ষিকীর হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। এজন্য এ ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার চিত্র জানা সম্ভব হয়নি।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক মাসরুর আরেফিন বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের জন্য বড় বিষয় নয়। এখন সময় হলো সম্পদের গুণগত মান ঠিক রেখে মূলধনের ভিত শক্তিশালী রাখা। ব্যাংক কখনই স্বল্পমেয়াদি কোনো ব্যবসা নয়। গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রেখে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকাই যেকোনো ব্যাংকের বড় সফলতা।
বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংকের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সিটি ব্যাংকের ২০২০ সালের পরিচালন মুনাফা থেকে আমরা অতিরিক্ত ১৭০ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছি। চলতি বছরও পরিচালন মুনাফা থেকে ২০০ কোটি টাকা বাড়তি সঞ্চিতি রাখতে চাই। দেশের অন্য ব্যাংকগুলোরও একই পন্থা অনুসরণ করা দরকার।
আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ ও কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। গত ৩০ জুন ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের অর্ধবার্ষিকের আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষ হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৯৯ কোটি টাকা। চলতি বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৫০৫ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫০৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৯৯ কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীরা ভালো না থাকলে ব্যাংকের পক্ষে ভালো থাকার সুযোগ নেই বলে মনে করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউও চোখ রাঙাচ্ছে। সরকার ঘোষিত লকডাউন দিন দিন কঠোর করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ভালো থাকার সুযোগ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি খারাপ হলে তার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংকের ওপর পড়ে। তাই আপতত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন।
আবুল কাশেম মো. শিরিনের ভাষ্য হলো, কিছু ব্যাংক পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ থেকে ভালো মুনাফা করেছে। আবার আগে কিনে রাখা সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের মুনাফার কারণেও কিছু ব্যাংকের মুনাফার চিত্র ভালো দেখাচ্ছে।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৪৮৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্যাংক এশিয়া। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৪৭২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৩৪৮ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফায় ছিল। চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফায় ৪৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। এ সময়ে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৫৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে ২৪৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক।
ইসলামী ধারার এক্সিম ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৩৪৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। গত বছর একই সময়ে ২৩৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। এছাড়া চলতি বছরের প্রথমার্ধে এনসিসি ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১৫ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ২৭৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল।
২০২০ সালের প্রথমার্ধে ২৬৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করা ঢাকা ব্যাংক এ বছর ৩১০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেন, করোনার আঘাতের পর আমরা ব্যাংকের অপ্রয়োজনীয় পরিচালন ব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে এনেছি। পাশাপাশি ব্যাংকের কস্ট অব ডিপোজিটও কমেছে। চলতি বছরের প্রথামার্ধে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঢাকা ব্যাংক বেশ ভালো করেছে। এসব কারণে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফায় ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১৮৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে তা ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৩১০ কোটি, যমুনা ব্যাংক ২৮৫ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ২২৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে চলতি বছরের প্রথমার্ধে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ২৮০ কোটি টাকা।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছর অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাত ছিল পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। মৃত্যু ও সংক্রমণের তুলনায় মানুষ আতঙ্কিত ছিল বহুগুণ। গত এক বছরে করোনার সঙ্গে বিশ্ববাসী অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে। এ কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি হলেও মানুষের মনের আতঙ্ক অনেকটা কেটে গেছে। গত ছয় মাসে অর্থনীতি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে শুরু করেছিল। ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার চিত্র তারই জানান দিচ্ছে। তবে সম্প্রতিক সময়ে আবার যেভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে, সেটি অর্থনীতি ও ব্যাংকের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বছরের প্রথমার্ধে ভালো পরিচালন মুনাফা করেছে ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও। এনআরবিসি ব্যাংক ১৫০ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ১২৭ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি) ৮০ কোটি ও মেঘনা ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে এ ব্যাংকগুলোর মধ্যে এনআরবিসি ৯১ কোটি ও মধুমতি ১২৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল। এসবিএসি ও মেঘনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল যথাক্রমে ৭০ ও ১২ কোটি টাকা। - বণিক বার্তা