নিউজ ডেস্ক: ‘করোনা মহামারি মধ্যে দেশে দুই কারণে স্বাভাবিক ব্যবস্থায় প্রসব বেড়েছে। করোনা শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে অজানা ভয় ছিল যে কারণে গুরুতর না হলে কেউ হাসপাতালে যায়নি। এতে করে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সিজার কমে আসছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে শুরু দিকে দীর্ঘদিন ধরে দেশ লকডাউনে। ইচ্ছা থাকলেও হাসপাতালে আসতে পারেনি মানুষ। এই কারণে সিজারের সংখ্যাও কমে এসেছে।’
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্তান প্রসবে সিজার নামে পরিচিতি পাওয়া সি সেকশন অপারেশন করতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে অনুৎসাহিত করা হলেও গত এক দশকে এই হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে গত এক বছর ধরে করোনার সময় দেখা গেছে উল্টো চিত্র।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিজারের মাধ্যমে ৮৭ হাজার ৩২১টি শিশুর জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে মার্চ থেকে দেখা দেয় করোনার সংক্রমণ। কিন্তু মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কত শিশুর জন্ম, সেই তথ্য আলাদাভাবে নেই।
তবে আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে একটি ধারণা পাওয়া যায় সিজার কমার বিষয়ে।
২০১৯ সালে এই অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন এক লাখ ১৫ হাজার ৭৬৩ জন মা। অর্থাৎ ওই বছরের তুলনায় ২০২০ সালে সিজার কমেছে ২৪.৫ শতাংশ।
শিশু নিয়ে কাজ করা বহুজাতিক এনজিও সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার (মেটারনাল অ্যান্ড নিউবর্ন হেলথ) আফসানা করিম বলেন, ‘করোনা মহামারি মধ্যে দেশে দুই কারণে স্বাভাবিক ব্যবস্থায় প্রসব বেড়েছে। করোনা শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে অজানা ভয় ছিল যে কারণে গুরুতর না হলে কেউ হাসপাতালে যায়নি। এতে করে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সিজার কমে আসছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে শুরু দিকে দীর্ঘদিন ধরে দেশ লকডাউনে। ইচ্ছা থাকলেও হাসপাতালে আসতে পারেনি মানুষ। এই কারণে সিজারের সংখ্যাও কমে এসেছে।’
এনজিওটির আরেক শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘সরকারি ও বেসরকারিভাবে দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে মানুষের মাঝে সিজার নিয়ে কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই সিজারের হার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে অনেকটা কমেছে।’
চলতি বছরের শুরুতে করোনা পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারের সংখ্যা আরও কমেছে বলে ধারণা করছে সেভ দ্য চিলড্রেন। মানুষের সচতেনতা বাড়লে এ হার আরও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছে তারা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের এই ধারণা যে ভুল নয়, সেটি বোঝা যায় সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান পরিবার ও পরিকল্পনা অধিদপ্তর (ডিজিএফপি) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের চিত্রে।
ডিজিএফপি দেয়া তথ্যমতে, তাদের হাসপাতালগুলোতে ২০১৯ সালে এক লাখ ৭৮ হাজার ৭৮১টি স্বাভাবিক প্রসব হলেও অস্ত্রোপচার হয় ৯ হাজার ৩৭৮টি।
২০২০ সালে এসে সেই সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামে। এ সময় এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৫টি নরমাল ডেলিভারি হলেও সিজার হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৩৭০টি।
চলতি বছরে এসে এই হার আরও কমেছে। জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৯১৬টি স্বাভাবিক প্রসবের বিপরীতে সিজার হয়েছে ৪০৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৩ হাজার ৭৮৪টি স্বাভাবিক প্রসবের বিপরীতে সিজার হয়েছে ৪৩৪টি, মার্চে ১৩ হাজার ৯৭৯টি স্বাভাবিক প্রসবের বিপরীতে সিজার হয়েছে ৫৫৫টি এবং এপ্রিলে ১২ হাজার ৯৯৯টি স্বাভাবিক প্রসবের বিপরীতে সিজার হয়েছে ৪৬৭টি।
কত শতাংশ সিরাজ গ্রহণযোগ্য?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, কোনো দেশেই মোট প্রসবের ১০ থেকে ১৫ ভাগের বেশি সি-সেকশন হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রসূতিদের ভুল বুঝিয়ে অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় সিজার করানোর ফলে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালে অপ্রয়োজনীয় সিজারের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ।
২০১৮ সালে দেশে যত মায়ের সিরাজ অপারেশন লাগত, তার তিন গুণ মাকেই অপ্রয়োজনীয় অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সিজারের হার আশঙ্কাজনকহারে বেড়েই চলেছে, যার ৮০ শতাংশই হয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। সিজারের ফলে মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে।
এনজিওটির কর্মকর্তা বলছেন, তারা কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, স্বাভাবিক সন্তান প্রসব নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে অনেক নারী সিজারে আগ্রহী হন। আবার অনেক সময় ঝামেলা এড়াতেও দীর্ঘ মেয়াদে অসুস্থতার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সিজার করতে রাজি হয় অনেক পরিবার। পাশাপাশি অভিযোগ করা হয়ে থাকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রয়োজনের সিজার করতে বাধ্য হন অনেকে।
সিজার নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা
সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্টপ আননেসেসারি সি–সেকশন নামের একটি উদ্যোগ কাজ করছে। সেভ দ্য চিলড্রেন, আইসিডিআরবি ও ব্রাকের সমন্বয়ে এটি গড়ে ওঠে।
সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাক ও আইসিসিডিআরবির সম্মিলিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যত শিশুর জন্ম হয়েছে, তার প্রতি ১০০ টির ৮৩টিই জন্ম নিয়েছে সি সেকশন অপারেশনের মাধ্যমে।
এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে এই হার অর্ধেকেরও বেশি কম। শতকরা ৩৯ জন মা এসব হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন।
সরকারি হাসপাতালে এটি আরও কম। সেখানে যত শিশুর জন্ম হয়, তার মধ্যে ৩৫ শতাংশ হয় সিরাজিয়ানের মাধ্যমে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছিল, বাংলাদেশে দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এতে বলা হয় ২০০৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সিজার ৪ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
পরে বিষয়টি আমলে নেয় আদালতও। সে সময় জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার রোধে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দেয়। তবে এটি এখনো পুরোপুরি বাস্তাবায়ন করতে পারেনি সরকার।
বেড়েছে মাতৃমৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, করোনাকালে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রসবপূর্ব সেবা আগের বছরের তুলনায় কম নিয়েছে মায়েরা।
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এ সেবা নেওয়ার হার এক–চতুর্থাংশ কমেছে। আর এ সময়ে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
মাতৃমৃত্যু বাড়ার পেছনেও দুটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পেতে হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে। আবার চিকিৎসকের কাছেও যেতে চাননি বহু মানুষ। ঘরে অপ্রশিক্ষিত দাই দিয়ে প্রসবের চেষ্টা বেড়েছে। কাজেই এই একটি বছরের চিত্র দিয়ে এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।