আফরোজা সরকার : [২] আটটি জেলা নিয়ে রংপুর বিভাগ ও আটটি উপজেলা নিয়ে রংপুর জেলা গঠিত সেখানে রয়েছে একটি সিটি কর্পোরেশন । সিটি কর্পোরেশন ৩৩ টি ওর্য়াড নিয়ে গঠিত হয়েছে।
[৩] শুরুতে রংপুর সিটিতে বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যাপক হারে বেড়েছে। এক মাসের পরিসংখ্যান করে দেখা গেছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ৭৭ থেকে ৮০ টি ।আর এসব বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা করোনাকালে আগের চেয়ে বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি বেড়েছে ।
[৪] আদালত সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে প্রতিমাসে দেড় শতাধিকের বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনপত্র আদালতে জমা পড়ছে। আর শুধু জুন মাসে গড়ে ৭৭ থেকে ৮০টি বিচ্ছেদের ঘটনায় আবেদন পত্র জমা পড়েছে। আর এসব ঘটনার জন্য করোনায় ঘর বন্ধি মানুষ পারিবারিক কূটনামি থেকে ঘটছে।
[৫] গেল এক বছরে রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) এলাকায় সহস্রাধিক বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। নগেররে বাইরে জেলার বাকি আট উপজেলাতেও হরহামেশাই ঘটছে এরকম ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছেদের এ তকমায় এগিয়ে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। রয়েছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও। যাদের গড় বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর।
[৬] রসিকের সাধারণ শাখার তথ্যই অনুযায়ী দেখা গেছে, পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি জুন পর্যন্ত মহানগর এলাকার ৩৩টি ওয়ার্ডে ৯৬০টিরও বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। তালাক দেওয়ার তালিকায় নারীরা একধাপ এগিয়ে। তবে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে নারীরা এখন অনেক বেশি হারে তালাক দিচ্ছে বলে জানান রসিকের সাধারণ শাখার উচ্চমান সহকারী নাইমুর হক নাইম।
[৭] সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর সিটির বর্ধিত এলাকা ছাড়াও শহুরের কমবেশি শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, শ্রমজীবী-চাকরীজীবীসহ যেকোন পেশার মানুষ পারিববারিক অশান্তি, বিরোধ, কোলহের জেরে সাংসারিক সম্পর্কের সমাপ্তি টানছেন। বিচ্ছেদের এই তালিকায় যৌতুক নিয়ে বিরোধ আর পরিবারের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হচ্ছে অনেক বেশি, পালিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে বিয়ে, কারো প্ররোচণায় পড়ে বিয়ে এবং অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে করা ছেলে-মেয়েরা রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সের এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। এছাড়াও বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ রয়েছে।
[৮] নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া এলাকার বিচ্ছেদ হওয়া এক নারী আমাদের অর্থনীতিকে জানান, নিম্নআয়ের পরিবারের আমার জন্য। অভাবের কারণে পড়ালেখাও তেমন করা হয়নি। অল্প বয়সে বিয়ে,বিয়ের সময়ে ছেলের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছিলেন । আমার বাবা দেড় লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে আমাকে বিয়ে দেন। কিন্তু বাকি টাকার জন্য সবসময়ই খটকা দিত শ্বশুড়বাড়ির লোকজন। যৌতুকের টাকা না দিতে পারায় স্বামী আমাকে মারধর করত। খাওয়া কষ্ট থেকে শুরু করে, আমি বিভিন্ন ভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি, বাধ্য হয়ে তালাক দিতে হয়েছে আমাকে। আমি এখন একটা সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে আছি। আর বিয়ে করব না, ভাগ্যে যা ছিল হয়েছে। প্রয়োজনে বাসা বাড়িতে কাজ করে খাবো।
[৯] রংপুর নগরীর কেল্লাবন এলাকার এক কৃষকের মেয়ে জানুয়ারি মাসে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেন। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই সংসার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। দুজনের অপ্রাপ্ত বয়স আর দাম্পত্য জীবনে ভুল বোঝাবুঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
[১০] নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ওই তরুনী বিচ্ছেদের অনলে পোড়া ওই তরুণী আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, স্বামী নেশা করত এবং বেকার ছিল। প্রেমের সম্পর্ক ধরে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ভিন্ন আচরণ শুরু করে। নেশার টাকার আমাকে নির্যাতন করত। টাকার জন্য কিছুদিন পর পর বাবার বাসায় পাঠিয়ে দিত। এরকম অত্যাচার সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সম্ভব হয়নি। বাবা-মার অনুমতি ছাড়া নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করে জীবনে এমন যন্ত্রণা নেমে এসেছিল বলে মনে করছেন উঠতি বয়সের এই তরুণী।
[১১] এদিকে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাবার জন্য পারিবারিক অশান্তি, পরকীয়া এবং নারী নির্যাতনকে দুষছেন রংপুর মহানগর কাজী সমিতির সভাপতিহাফিজ মুহাম্মদ আব্দুল কাদির আমাদের অর্থনীতিকে জানান, অবাধ স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, মাদকাসক্ত, পরকীয়া আসক্তি, স্বামী-স্ত্রীর মতামতের পার্থক্য, যৌতুক, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি শিক্ষিত ও ধনী পরিবারেও বিচ্ছেদ হয়ে থাকছে।
[১২] সবকিছুর মূলে যৌতুক, পরকীয়া, শারীরিক নির্যাতন, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়াটাকে বিবাহ বিচ্ছেদের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখছেন এই কাজী। সঙ্গে ভারতীয় সিরিয়ালও সংসার জীবনে বিচ্ছেদের ঘটনায় নারী-পুরুষদের প্রভাবিত করছেন বলে দাবি তার। তিনি বলেন, অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে। এতে পুরুষদের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি।
[১৩] এ বিষয়ে রংপুর জজ কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল ইসলাম রানা আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দিন দিন বিবাহ বিচ্ছেদের অবস্থা করুণ। অথচ বিবাহবন্ধন একটি বিশ্বাস ও আস্থার প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা যা দেখছি, প্রতিনিয়ত ঠুনকো কারণে দাম্পত্য সম্পর্কগুলোর মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। যদিও বিবাহ বিচ্ছেদ রাষ্ট্রীয় আইন ও ব্যাক্তিগত আইনসম্মত একটি পদ্ধতি। তবে এটি অশোভন ও বেদনাদায়ক। এই চর্চার ব্যাপকতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে এটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হবে।
আপনার মতামত লিখুন :