টিআইবির গবেষণা
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপে টিকার বিকল্প উৎসের সন্ধান করা হয়নি * আইসিইউ সংকটে করোনা রোগীর জনপ্রতি গড় খরচ ৫ লাখ টাকা * দুর্নীতিবাজদের শাস্তির পরিবর্তে তথ্য নিয়ন্ত্রণে তৎপর সরকার
করোনা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে পদে পদে সুশাসনে ঘাটতি ছিল। রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, লকডাউন, টিকা ক্রয় এবং বিতরণে স্বচ্ছতা, সুশাসন ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় ছিল না। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপে টিকা ক্রয়ে বিকল্প উৎসের সন্ধান করা হয়নি। জাতীয় কমিটি, একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সাড়া না দেয়ায় ট্রায়াল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদনেও দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা গেছে। টিকা ক্রয়ে বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকটে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এতে একজন করোনা রোগীর গড় খরচ হয়েছে ৫ লাখ টাকা। এসব কাজে সামগ্রিকভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছে।
দুর্নীতি বিরোধী আর্ন্তজাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় উঠে এসেছে উল্লিখিত সব তথ্য। মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন। সংস্থাটি বলছে, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না দিয়ে তথ্য নিয়ন্ত্রণে তৎপর ছিল সরকার। এ সময়ে করোনা মোকাবিলায় আগামী দিনের জন্য ১৯টি সুপারিশ করে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সংক্রমণের ১ বছর ৩ মাস পার হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি চিকিৎসা সুবিধার সম্প্রসারণ করা হয়নি। বাজেট এবং যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও সব জেলায় ১০টি করে আইসিইউ শয্যা প্রস্তুতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সংকটে সাধারণ মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে একজন করোনা রোগীর গড় খরচ হচ্ছে ৫ লাখ টাকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ দশমিক ৮ কোটি মানুষকে (জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ) টিকার আওতায় নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে অনুযায়ী টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। টিকা সংরক্ষণে দূরদর্শিতার ঘাটতিতে নির্ধারিত সময়ে ১৩ লাখের বেশি টিকাগ্রহীতার দ্বিতীয় ডোজ অনিশ্চিত। আবার অনলাইনভিত্তিক নিবন্ধন হওয়ার ফলে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে অন্যের সহায়তায় নিবন্ধন নিতে হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ টিকাগ্রহীতা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। এদের প্রায় ৭৮ শতাংশকে নিবন্ধন করতে ৫ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে। অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা সত্ত্বেও কিছু পেশা/জনগোষ্ঠীর মানুষের বয়স ৪০ বছর না হওয়ায় তারা নিবন্ধন করতে পারেননি। আবার পেশা/জনগোষ্ঠী যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় অগ্রাধিকার তালিকার বাইরে থেকে অনেকে টিকা গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যথাযথভাবে এলাকাভিত্তিক টিকার চাহিদা যাচাই না করায় সরবরাহ না থাকায় কোনো এলাকায় আকস্মিক সংকট এবং কোনো এলাকায় টিকা উদ্বৃত্ত থাকা ও ফেরত দেয়া হয়েছে। আবার চাহিদা যাচাইয়ের মাধ্যমে বিদেশগামীদের যথাসময়ে টিকার আওতায় আনা হয়নি। টিকা সনদ না থাকায় প্রত্যেকের গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে স্বল্প আয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির হার খুবই কম। টিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের হারও কম। প্রচারে ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধনের ব্যবস্থা না করায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সব কর্মীকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। টিকাদান কেন্দ্রেও নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। নির্ধারিত কেন্দ্রে টিকা নিতে গিয়ে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ২৭ দশমিক ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ৫০ দশমিক ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি। ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ গ্রহীতাকে টিকা দেয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করা হয়নি। টিকা কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ টিকা কেন্দ্রে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থাই নেই। টিকাগ্রহীতার ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ কোনো অভিযোগ করতে পারেননি। ২২ দশমিক ১ শতাংশ কীভাবে অভিযোগ জানাতে হয় তা জানেন না।
গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা সংগ্রহ এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও ক্রয় চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি বিদ্যমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটি উৎস ছাড়া বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। জাতীয় কমিটি এবং বিএমআরসি একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ সাড়া না দেয়ায় ট্রায়াল প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদনেও দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যেকার টিকা ক্রয় চুক্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল প্রকট। টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি। যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ (২ দশমিক ১৯ ডলার), ভারত (২ দশমিক ৮ ডলার), আফ্রিকান ইউনিয়ন (৩ ডলার) ও নেপালের (৪ ডলার) চেয়ে বেশি মূল্যে কোভিশিল্ড টিকা ক্রয় (৫ ডলার) করা হয়েছে। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচত তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করা যেত। ক্রয় বিধি ২০০৮, এর ৩৮(৪)(গ) অনুসরণ না করে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সব পক্ষকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিনিধিদের মধ্যে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও আছেন, যা আইনের লঙ্ঘন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ [অনুচ্ছেদ ১২ (কে)] অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন কেউ সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবেন না।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বিভিন্ন হাসপাতালের ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত ছিল। যেমন পাঁচটি হাসপাতালে ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগ ও কোয়ারেন্টিন বাবদ ৬২ দশমিক ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কোটি টাকার দুর্নীতি; ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করে এক লাখ কিট ক্রয়; বিধি লঙ্ঘন করে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ প্রদানের ঘটনা দেখা গেছে। করোনাকালে কারিগরি জনবলের ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষের অভিযোগ উঠেছে। উপযোগিতা যাচাই না করে হাসপাতাল নির্মাণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার না করে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ৩১ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের ক্রয়ে সংঘটিত দুর্নীতির কারণে বারবার পরিচালক পরিবর্তন, ধীরগতির তদন্ত কার্যক্রমের প্রভাবে ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। দুর্নীতিতে জড়িত কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। সরকার ঘোষিত মোট ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজে বরাদ্দকৃত ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ বিতরণ করা হয়নি। বৃহৎ ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রণোদনার অধিকাংশ বিতরণ হলেও কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং নিু আয়ের জনগোষ্ঠীর প্রণোদনা বিতরণে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। এছাড়া করোনাকালীন তথ্য প্রকাশের কারণে গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি, নির্যাতন ও মামলার শিকার হওয়া অব্যাহত ছিল। অতিমারি নিয়ে লেখালেখির কারণে ২০২০ সালে ৮৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করা সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় নির্যাতনের শিকার ও আটক হন, তার বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩- এ মামলা করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘করোনা সংক্রমনের শুরু থেকে বিগত দেড় বছর ধরে স্বাস্থ্যখাতে যে ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ছিল, তা এখনো অব্যাহত আছে। সরকারি ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে, জনবল নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, উপযোগিতা নিশ্চিত না করে হাসপাতাল সাময়িকভাবে প্রস্তুত এবং তা বন্ধ করার ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত ছিল, তথ্য নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যতখানি তৎপর তার চেয়ে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে শতগুণে বেশি তৎপর ছিল। যা আত্মঘাতী বিষয়, এ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। সূত্র: যুগান্তর