ভূঁইয়া আশিক রহমান : [২] বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ছয় দফা বঙ্গবন্ধুর একটি কুশলি দলিল ছিলো, যার লক্ষ্য বাঙালির মুক্তি [৩] ছয় দফা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা ধোপে টিকেনি।
[৪] বেগম মুজিবকে ৬ দফার বিরোধিতাকারীরা বোঝালেন, এই ৬ দফা দিয়ে কাজ হবে না, ৮ দফা দিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। জবাবে বেগম মুজিব বললেন, ‘আমি অতোসতো বুঝি না, উনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন ৬ দফা, আমি ৬ দফাই বিশ^াস করি’ [৫] আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কিশোরী শেখ হাসিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলোÑ ‘৬ দফা নয়, ৮ দফা হওয়া উচিত’। উত্তরে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আব্বা বলে দিয়েছেন যা, সেটাই ঠিক’।
[৬] মাগনা কার্টারের সঙ্গে ৬ দফার তুলনা অযৌক্তিক [৭] ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের যে জন্ম হলো, তখন যে দাবিনামা ছিলো, তাতে স্বায়ত্বশাসনের কথা বলা হয়েছিলো [৮] ছয় ফেব্রæয়ারি লাহোরের উর্দু দৈনিক, ‘নাওয়াই ওয়াক্ত’ পত্রিকায় প্রথম পাতায় শীর্ষ খবর হিসেবে যে শিরোনামটি দিয়েছিলো, তাহলোÑ‘শেখ মুজিব কা ছে নোক্তা খতরনাক’ অর্থাৎ শেখ মুজিবের ৬ দফা ভয়াবহ!
[৯] ছয় দফা বঙ্গবন্ধুর একটি কুশলি দলিল ছিলো, যার লক্ষ্য বাঙালির মুক্তি, সে কারণেই ৬ দফাকে বাঙালির মুক্তির সনদ বলা হয় । যা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। তবে ছয় দফাকে কখনো কখনো ‘ম্যাগনা কার্টা’-এর সঙ্গে তুলনায় করা হয়, যার সঙ্গে আমি একমত নই। এই তুলনাটি অনৈতিহাসিক। কারণ ১২১৫ সালে বিশপ ল্যাংটনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের ভ‚স্বামীরা রাজা জনের বিরুদ্ধে একটি দলিল দাঁড় করিয়েছিলো। ওই দলিলে ভ‚স্বামীদের অধিকারের কথা বলা ছিলো। যদিও বলা হয়, ১২১৫ থেকে ইংল্যান্ডে গণতন্ত্রের দিকে অভিযাত্রা শুরু করেছিলো। কিন্তু ছয় দফা ছিলো আপামর বাঙালির মুক্তির সনদ। ফলে মাগনা কার্টারের সঙ্গে ছয় দফার তুলনা অযৌক্তিক।
[১০] ছয় দফা নিয়ে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা হয়েছিলো। যেমন মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ছয় দফা সিআইয়ের দলিল। বিপরীতে তিনি তার ১৪ দফা তৈরি করেছিলেন। যা অবশ্য ধোপে টিকেনি। আবার পিডিএম ৮ দফা দাঁড় করিয়েছিলো। তবে কোনোটাই ধোপে টিকেনি। ৬ দফাই বাঙালিরা গ্রহণ করেছিলো এবং বঙ্গবন্ধুকে তারা তাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলো।
[১১] বাম বুদ্ধিজীবীরা বলতেন, ৬ দফা তৈরির করার মতো লেখাপড়া ও মেধা শেখ মুজিবুরের ছিলো না! কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের যে জন্ম হলো, তখন যে দাবিনামা ছিলো তাতেও স্বায়ত্বশাসনের কথা বলা হয়েছিলো। উপরন্তু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২১ দফা ছিলো, তার ১৯তম দফাই ছিলো স্বায়ত্বশাসনের জন্য।
[১২] বেসিক প্রিন্সিপল কমিটির যে রিপোর্ট নিয়ে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় একটা মহাসম্মেলন হয়েছিলো রাজনীতিবিদদের, সেখানেও পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো। ১৯৬৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগ ১১ দফা দাবি প্রণয়ন করেছিলো এবং সেটাও ছিলো স্বায়ত্বশাসনের লক্ষ্যে তৈরি। ফলে বঙ্গবন্ধু ৬ দফায় নতুন কিছু বলেননি। তিনি ১৯৪৯ সাল থেকে বাঙালিদের যে আকাক্সক্ষা ছিলো, তারই সমন্বিত রূপ প্রকাশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবির মধ্যদিয়ে।
[১১] ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বাঙালিরা যতো আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলো, তাতে স্পষ্ট করা হয়েছিলোÑ বাঙালি দারুণভাবে বঞ্চিত। শোষিত। উপনিবেশে পরিণত হয়েছিলো পাকিস্তানের। ফলে ৬ দফা নিয়ে যতো বিতর্কই থাক, বাঙালিরা তা গ্রহণ করেছিলো। ৬ দফার নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রহণ করেছিলো। শেখ মুজিব তখনো বঙ্গবন্ধু হননি।
[১২] ৬ দফা দাবির কোথাও স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি। ফলে ৬ দফাকে সরাসারি স্বাধীনতার দলিল বলা ইতিহাসের দিক থেকে একটি সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা নিয়ে অন্তত তিনজনকে কিছু কথা বলেছিলেন, যা থেকেই আমরা ৬ দফার নিহিতার্থ বের করতে পারি। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, তিনি মস্কোপন্থী নেতা ছিলেন। প্রায় বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী। একবার অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ একটি বিতর্কিত পরিবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করলেন যে, আপনার ৬ দফার মূল অর্থটা কী হতে পারে। জবাবে বঙ্গবন্ধু মেঠো বাংলায় বলেছিলেন, ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই, একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ আমাকে বলেছিলেন, এর পরে শেখ মুজিবকে আমি আর কোনো প্রশ্ন করিনি। কারণ বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন।
[১৩] আব্দুর রাজ্জাক, ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা। ১৯৬২ সালে তৈরি হওয়া সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গোপন সংগঠন, ‘নিউক্লিয়াস’-এর অন্যতম নেতা ছিলেন। এই নিউক্লিয়াস বাঙালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা করেছিলো। সেই আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমরা ছাত্ররা যখন আপনার নির্দেশে স্বাধীনতার কথা ভাবছি, তখন আপনি শুধু স্বায়ত্বশাসনের কথা বললেন কেন? বঙ্গবন্ধু আব্দুর রাজ্জাকের পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের ওপারে যাওয়ার সাঁকো তৈরি করে দিলাম’। আব্দুর রাজ্জাক আমাকে বলেছিলেন, এরপরে আমিও আর শেখ মুজিবকে কোনো প্রশ্ন করিনি।
[১৪] প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তখন বিবিসি বাংলায় কাজ করতেন। বিবিসির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তাকে বলা হয়েছিলো। তিনি বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘৬ দফা কী, আপনি ব্যাখ্যা করুন।’ বঙ্গবন্ধু মেঠো বাংলায় সৈয়দ শামসুল হকের সামনে তিনটি আঙুল তুলে বলেছিলেন, ‘আমার দফা আসলে তিনটাÑ কতো নেছো, কতো দেবা, কবে যাবা’! বিবিসিতে সাক্ষাৎকারটি ওভাবেই প্রচারিত হয়েছিলো। ফলে তিনজনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে মনে মনে হয়Ñ বঙ্গবন্ধু একটি কৌশলের অবলম্বন করেছিলেন, যে কৌশলে তিনি বাঙালির মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের কৌশল প্রয়োজন, অপকৌশল নয়। কারণ অপকৌশল অপরাজনীতির জন্ম দেয়।
[১৫] ৬ দফা আসলে শুধু ৬ দফা ছিলো না। তাহলে কী ছিলো! ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি লাহোরে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের সম্মেলন হয়েছিলো, তার প্রধান লক্ষ্য ছিলো বয়স্কদের ভোটাধিকার দাবি করা। সেখানেও বঙ্গবন্ধু ৬ দফাভিত্তিক প্রস্তাবগুলো রেখেছিলেন। তবে তার পেছনে একটি পটভ‚মি আছে। বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না। কারণ তার চিন্তা ছিলো বাঙালির মুক্তি। তিনি লাহোরে যেতে চাননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যিনি কোনোদিন আওয়ামী লীগ করেননি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে সবসময় বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘তুমি যাও’। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঠিক করেছিলেন, লাহোরে তিনি পাঠাবেন শাহ্ আজিজুর রহমানকে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বললেন, ‘শাহ আজিজ তো কিছুদিন আগেও পাকিস্তানপন্থী ছিলো, ওকে বিশ্বাস করা যায় না। তোমার যা বলার নোট করে নিয়ে গিয়ে বলে এসো’। সেই সুবাধেÑ বঙ্গবন্ধু লাহোর গিয়েছিলেন।
[১৬] ৫ ফেব্রুয়ারি যখন সাবজেক্ট কমিটিতে বঙ্গবন্ধু তার ৬ দফা তুলে ধরতে চাইলেন, তা নাকোচ করা হলো চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু রাগ করে বেরিয়ে গেলেন এবং সেদিনই বিকেল বেলা লাহোরে সাংবাদিকদের সামনে ৬ দফার মূল কথা তুলে ধরলেন। ৫ ফেব্রæয়ারি সন্ধ্যাবেলা, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত, সান্ধ্য দৈনিক ‘আওয়াজে’ ৬ দফার মূল বক্তব্য ছেপে দেওয়া হয়েছিলো। ছাত্রলীগের কর্মীরা তখনকার পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশজুড়ে পোস্টার সেঁটেছিলো ৬ দফার পক্ষে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কৌশলে ৬ দফার পক্ষে জনমত তৈরি করতে চাইলেন। ৬ ফেব্রæয়ারি লাহোরের উর্দু দৈনিক, ‘নাওয়াই ওয়াক্ত’ পত্রিকায় প্রথম পাতায় শীর্ষ খবর হিসেবে যে শিরোনামটি দিয়েছিলো, তাহলোÑ‘শেখ মুজিব কা ছে নোক্তা খতর্কনাক’। অর্থাৎ শেখ মুজিবের ৬ দফা ভয়াবহ। ওই প্রথম ৬ দফার কথা এসেছিলো।
[১৭] ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে ৬ দফার সারবস্তু তুলে ধরেছিলেন। আঠারো থেকে বিশ মার্চÑআওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় ৬ দফা দাবি তুলে ধরা হলো। কিন্তু এই দফাগুলোর বিরোধিতা ছিলো অনেকেরই এবং তারা বলেছিলেন, এটা কাউন্সিলে পাস করাতে হবে। জুন মাসে ৬ দফা কাউন্সিলে পাস করানো হয়। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ কয়েকজন সমর্থকসহ বেরিয়ে গেলেন আওয়ামী লীগ থেকে। অর্থাৎ তিনি ৬ দফার বিরোধিতা করলেন। ইতোমধ্যে ৬ দফার পক্ষে গণজোয়ার শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেকেই অবস্থান নিলো। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কিশোরী শেখ হাসিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, ৬ দফা নয়, ৮ দফা হওয়া উচিত। শেখ হাসিনা বললেন, ‘আব্বা বলে দিয়েছেন যা, সেটাই ঠিক’।
[১৮] তখন শেখ হাসিনার মা বেগম মুজিবকে তারা বোঝালেন, এই ৬ দফা দিয়ে কাজ হবে না, আমাদের ৮ দফা দিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। জবাবে বেগম মুজিব বললেন, ‘আমি অতোসতো বুঝি না, লেখাপড়া জানি না, উনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন ৬ দফা, আমি ৬ দফাই বিশ্বাস করি’। কাজেই আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষ নানান ভাবে চেষ্টা করেছিলো, ৬ দফা থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিবৃত্ত করার। কিন্তু কাজ হয়নি। ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হয়ে গেলো।