কামরুল হাসান মামুন: বাংলাদেশীরা কেন বাংলাদেশ ছেড়ে ইউরোপ আমেরিকায় বসত করে ওখানকার নাগরিক হচ্ছে সেটা আজকে উদাহরণসহ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব। প্রধানত দুই ক্লাসের মানুষ বাংলাদেশ ছাড়ছে। একটি ক্লাস হলো দেশের উচ্চবিত্তের ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজদের একটি বড় অংশ যারা বিদেশে টাকা পাচার করে বিদেশে বেগমপাড়া, সন্তানপাড়া, দ্বিতীয়পাড়া বানিয়ে একসময় বৌ পোলাপান নিয়ে সটকে পরছে। এদের জন্য কেবলই ঘৃণা। এই ঘৃণা প্রকাশের জন্য আমাদের একটি ঘৃণা প্রকাশ দিবস করে প্রতিবছর ঐদিন বাংলাদেশের টয়লেটগুলোতে সেটে দিয়ে প্রস্রাব অথবা থুথু দিব আমরা। আরেকটা শ্রেণী আছে উচ্চমেধাসম্পন্ন। যারা পড়াশুনা করতে ইউরোপ আমেরিকায় গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে যখন দেশে ফেরার সময় হয় তখন দেশে ফিরে উপযুক্ত চাকুরী পাওয়া নিয়ে বিশাল অনিশ্চয়তায় ভুগে। আসলে এইটা অনিশ্চয়তা না বরং আমি বলতে পারি নিশ্চিতভাবেই তারা ফিরে আসলে চাকুরী হবে না। যেমন কেউ যদি পিএইচডি এবং/অথবা পোস্ট-ডক শেষে ফিরে আসে তার বয়স ৩৫ এর উপরে থাকবে।
আর দ্বিতীয়ত যারা এত বছর উন্নত বিশ্বে কাটায় তাদের চোখ কান খুলে যায়। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডে যারা থাকে তাদের চেয়ে এরা অধিক স্মার্ট। এছাড়া এরা এতই স্মার্ট যে এদেরকে রাজনীতির নোংরামিতে ঢোকানো কঠিন হতে পারে। ফলে আমাদের নিয়োগ সিস্টেমটাই এমন করা হয়েছে যেন তারা কোনভাবেই ঢুকতে না পারে। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, আণবিক শক্তি কমিশন, সাইন্স ল্যাব, সরকারি বড় বড় কলেজ ইত্যাদি সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সত্য। অথচ ভারতের ইউজিসি ঘোষণা করেছে যে ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং-এর ৫০০-র মধ্যে আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করলে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। আমাদেরকে দুটো কাজ করতে হবে। শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য একটা পৃথক বেতন স্কেল চালু এবং এইরকম মেধাবীদের কিভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সেইরকম করে আমাদের নিয়োগ নীতিমালা তৈরী করতে হবে।
এই যে অর্থবিত্ত ও জ্ঞানের এমন mass-scale এ পাচার চলছে এইটা ঠেকানো এবং উল্টানোর কোন পদক্ষেপ দেখছি না। এর ফলে দেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। তবে এইটা ঋনাত্বক বিপ্লব। একটি দেশ ভালো চলার জন্য অন্তত মোট জনসংখ্যার ২০% কে জ্ঞানে মননে এবং সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত হতে হয়। দেখা গেছে দিন যত যাচ্ছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেরও একটি বিরাট অংশ বিদেশ চলে গেছে। এখন দেশের সকল মানুষ তার সন্তানদের মানুষ করার অভিপ্রায়ে দেশ ছাড়ছে। যেই দেশে কথা বলার পরিবেশ নাই, সমালোচনা করার পরিবেশ নাই, সঠিক বিচার পাওয়ার পরিবেশ নাই, শিক্ষার মান নাই সেই দেশে কেন মানুষ থাকবে? কারো একটা মেয়ে থাকলে পাত্র হিসাবে এমন একজনকে খুঁজে যার কাছে বিয়ে দিলে মেয়েটা বিদেশ চলে যেতে পারবে। একটি দেশের অর্থবিত্তে বড় কিংবা জ্ঞানবুদ্ধিতে বড় তারা দেশ ছেড়ে চলে যায় তাহলে যেগুলো থাকে তারা ধানের চোঁচার মত। দেশ চালাচ্ছে এই চোঁচার দল।
চিন্তা করেন এইটা কেমন সভ্য দেশ যেখানে ভিআইপি ছাড়া রাষ্ট্রের কোন সুযোগ সুবিধাই পাবেন না। ভ্যাকসিনের কথাই বলুন। কোন গরিব মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছে? এই রাষ্ট্রে একজন এমপি বিনাশুল্কে কোটি টাকার গাড়ি আনতে পারেন কিন্তু একজন ছাত্র বা শিক্ষক হাজার টাকার বই আনতে গেলেও ট্যাক্স দিতে হয়। বিমানবন্দরে নামলেই ভিআইপির পথ আর সাধারণের পথ ভিন্ন হয়ে যায়। এইটাতো আল্টিমেট বৈষম্যের দেশ।
এইবার একজনের গল্প বলি। তার নাম রাউফুল আলম (Rauful Alam)। থাকে আমেরিকাতে। পেশায় একজন টপ ক্লাস বিজ্ঞানী। আমেরিকায় থেকে ছেলে সন্তান ও চাকুরী নিয়ে কেবল তাদের কথা আর বড় জোর নিজের বাবা মায়ের কথা ভেবেই জীবন পার করতে পারতেন। কিন্তু সে তা করছে না। দেশের শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বুদ্ হয়ে আছে। বাকি গল্পটা তার জবানিতেই শুনুন।
"আমি কেন দেশ ছেড়েছিলাম? আগের একটা পোস্টের সূত্রধরে, অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে।
আমি দেশ ছেড়েছিলাম লাঞ্ছনা থেকে বাঁচতে। দেশ ছেড়েছিলাম মানসিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে। সামাজিক অনাচার থেকে বাঁচতে।
আমার এই লাঞ্ছনা ও মানসিক নির্যাতনের জন্য আমি দায়ি ছিলাম না। কিন্তু আমাকে শিকার হতে হয়েছে।
কারণ আমি গ্রামের ছেলে ছিলাম। আমার আব্বা কোন বড় পদের চাকুরিজীবি ছিলেন না। তার তেমন অর্থ-কড়ি ছিলো না। তিনি সামান্য বেতনের চাকরি করতেন—টেনেটুনে সংসার চলতো। আমারও টাকা-পয়সা ছিলো না।
আমার কোন উচ্চপদস্থ আত্মীয় ছিলো না। আমার বাবার কোন মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিলো না। কোন রাজনৈতিক লবিং ছিলো না। সবচেয়ে বড়ো কথা, কাউকে ধরে সাঁকো পাড়ি দেয়ার মানসিকতা, জন্মগতভাবেই ছিলো না। —আমি বুঝেছিলাম, এইগুলো আমাদের দেশের জন্য একটা যোগ্যতা। যদি এগুলো না থাকে, তাহলে আপনাকে পুড়তে হবে। আপনাকে ভুগতে হবে।
প্রত্যেকটা কাজের জন্য হেনস্ত হতে হতো। ব্যাংক, থানা, হাসপাতাল, ভূমি অফিস, পার্সপোর্ট অফিস, চাকরির ইন্টারিভিউ, টিউশনি—এমন কোন জায়গা নেই যেখানে গিয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। সামাজিক আরো কতো অনাচার তো ছিলোই! আমি জেদ ধরে ঘুষ দেইনি বলে ছয় মাসেও আমার পাসপোর্টের কাজ হয়নি। ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আটকে রেখেছিলো। তারপর আমি এসপি’র কাছে গিয়েও অভিযোগ করেছিলাম। লাভ হয়নি। পরে আমাকে ঘুষ দিয়েই পাসপোর্ট করতে হয়েছে। —এ শুধু একটা উদাহরণ! চাকরির ইন্টারভিউগুলোর অভিজ্ঞতা লিখলে মহাকাব্য হবে!
গতো বারো বছর আমি ইউরোপ এবং আমেরিকায় কাটিয়েছি। তাদের ভাষার সাথে আমার ভাষার মিল নেই। ধর্মের মিল নেই। চেহারার মিল নেই। সংস্কৃতি, আচার, খাবারের মিল নেই। অথচ, অবাক করা বিষয় হলো আমাকে একটি বারও এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। কেউ কোনদিন আমার বাবার পরিচয় জানতে চায় নি। ধর্ম জানতে চায়নি। ঘুষ চায়নি। আমি কি টাকাওয়ালা নাকি রাস্তার ফকির—সেটা জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি আমার প্রফেসরগণ, যাদের সাথে ছয়-সাত বছর একটানা কাজ করেছি, তারা পর্যন্ত জানতে চায়নি—আমার বাবা কি করে কিংবা আমার ধর্ম কি!
কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার সময় ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি, আমার তো লোক নাই। আমার তো টাকা নাই। গত বারো বছরে আমার প্রতিটি কাজের জন্য রিওয়ার্ডের পর রিওয়ার্ড এসেছে। আর্থিক হোক, সম্মান হোক কিংবা সনদ হোক! কখনো সেটার জন্য কাউকে গিয়ে বলতে হয়নি। কেউ না কেউ আমার ঘাড়ের উপর কাজের মূল্যায়ন করছে। আমি একবারও ভাবিনি, আমার কলিগ তো আমেরিকান কিংবা জার্মান কিংবা রাশিয়ান। তারা তো আমাকে বাংলাদেশি বলে উঠতে দিবে না। আমাকে কেউ পেছন থেকে টেনে ধরেনি। কেউ ল্যাং মারেনি।
কাউকে আমার কখনো কেয়ার করতে হয়নি। কোন নেতা, অফিসার, বস—কারো ভয়ে আমাকে চুপ থাকতে হয়নি। তটস্থ থাকতে হয়নি। সহমত, জ্বি স্যার করে করে দিন কাটাতে হয়নি। কাউকে উপহার দিয়ে, বাসায় দাওয়াত দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে হয়নি। আমার প্রফেসর, সহকর্মী, বস, ম্যানেজার কাউকে এ পর্যন্ত আমি এক টাকার গিফ্ট দেইনি। উল্টো ভেবেছি, উপহার দিলে ওরা মাইন্ড করবে!
কারো পরিচয় দিয়ে কোন কাজ করতে হয়নি। কে অফিসার, কে উলোট-পালট কর্মকর্তা—কেউ কাউকে কেয়ার করে বসে থাকে না। যে যার কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারকে ওরা শূণ্যের কোঠায় রাখার চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। অথচ, দেশে দেখেছি, কোথাকার কোন ওয়ার্ডের নেতা, সে পরিচয়ও গাড়িতে লাগিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ, তার জন্য রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াও! —নোংরা, ইতর! ক্ষমতার এবিউজের দিক দিয়ে, নাম্বার ওয়ান দেশ হলো বাংলাদেশ! একটা সামান্য কেরানি যেই ভাব নিয়ে থাকে, মনে হয় ফেরাউন এসেও তাকে নড়াতে পারবে না!
আমি এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে একজন মানুষকে তার জন্ম নিয়ে, জন্মস্থান নিয়ে, জেলা নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, গায়ের রং নিয়ে, উচ্চতা নিয়ে, বাপের পরিচয় নিয়ে, বাপের টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না।
রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ভাবতে না হয়। নেতা-ফেতার পরিচয় দিতে হবে না। কেউ যেনো কারো কাছে ক্ষমতা দেখাতে না হয়। নেতা-বস, ওমুক-তুমুকের সাথে সহমত আর চামচামি করে বাঁচতে হবে না। প্রত্যেকটা মানুষ একজন নাগরিক হিসেবে তার অধিকারটুকু পাবে। সর্বত্র। থানা, আদালত, অফিস, ব্যাংক, অধিদফতর—সব জায়গায়! নেতার কাজ আগে হবে, টাকাওয়ালার কাজ আগে হবে, অফিসার, সেলিব্রেটি, ইউটিউবারের কাজ আগে হবে—এইসব নোংরামি, ইতরামি যেনো না থাকে।
একজন মানুষ যেনো আত্মপরিচয়ে, কর্ম দিয়ে সবর্ত্র মূল্যায়িত হয়। তাকে যেনো কেউ আর কোনকিছু দিয়ে যাচাই না করে। আমি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্ন নিয়ে বলে যাই!
তারপরও যদি দেশপ্রেমের দোহাই দেন—তাহলে শুধু এটুকুই বলব, বাংলাদেশকে নিয়েই আমি গতো বারো বছর প্রতিদিন ঘুমাতে গিয়েছি। এবং প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেছি।"
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া।