স্বকৃত নোমান: আমরা বয়োজ্যষ্ঠদের পা ছুঁয়ে সালাম করি। এটা আমাদের সংস্কৃতি। এটাকে বলে থাকি কদমবুচি; যদিও কদমবুচি ঠিক এটাকে বলা হয় না। কদমবুচি অর্থ পদচুম্বন। কদম আরবি শব্দ, যার অর্থ পা। বুচি ফারসি শব্দ, যার অর্থ চুম্বন। কদমবুচি অর্থ পদচুম্বন। কিন্তু আমরা পায়ে চুম্বন করি না, পায়ে চুম্বনের রীতি প্রচলিত আছে গুরুবাদীদের মধ্যে, পীর-মুরিদদের মধ্যে। আপামর বাঙালি পায়ে হাত স্পর্শ করে হাতটা প্রথমে বুকে ঠেকায়, তারপর কপালে। এটা বয়োজ্যষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভারতবর্ষীয় একটি রীতি। পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে এই রীতি প্রচলিত আছে ঠিক জানি না। এখন একদল ওয়াহাবি-হেফাজতি ফতোয়াবাজ এসেছে, যারা বলে থাকে কদমবুচি হারাম। কারণ কদমবুচি করতে গেলে মাথা নোয়াতে হয়। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নোয়ানো শিরিক।
গত কুড়ি বছর ধরে এই ফতোয়া দেদারসে চলছে। দেখেন হেফাজতি ফতোয়াবাজদের কাণ্ড! কদমবুচি শিরিক হলে তো জমিনে রোয়া লাগানোও শিরিক, মাটি কাটাও শিরিক, ধান কাটাও শিরিক। কারণ এসব কাজ করার সময় মাথা নোয়াতে হয়। মাথা নুইয়ে আর যেসব কাজ করতে হয় সবই শিরিক। মিরপুরে একবার কার যেন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে এমন ফতোয়া দেখেছিলাম। কমিউনিটি সেন্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে কে যেন কাকে কদমবুচি করছিলো। অমনি একজন ফতোয়া দিয়ে বসল কদমবুচি হারাম। আমার মাথা ওঠলো টং করে। ধরলাম লোকটাকে পেঁচিয়ে। আমার পেঁচ থেকে ছাড়া পেতে সে বললো, ‘আপনি ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ, কুরআন-হাদিসের কথা আপনি বুঝবেন না।’ আমার মেজাজ গেলো আরও গরম হয়ে। কদমবুচির পক্ষে দিলাম একটা হাদিস ঝেড়ে। লোকটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি সরে এলাম। খানিকক্ষণ থাকলে হয়তো সে বলতো, ওটা জাল হাদিস। তারা তর্কে হেরে গেলে সাধারণত বলে, আপনার মুখে দাঁড়ি কই? মাথায় টুপি কই? আপনি ইংরেজি শিক্ষিত, ওটা জাল হাদিস ইত্যাদি।
আমি সাধারণত বিজ্ঞ জ্যষ্ঠদের কদমবুচি করে থাকি। সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, শওকত আলী, রফিক আজাদ, আবদুশ শাকুর, শামসুজ্জামান খান, সেলিম আল দীনসহ সিনিয়র সবাইকে কদমবুচি করতাম। এখনো যতীন সরকার, হাসান আজিজুল হকসহ অনেক সিনিয়রকে করি। কবি নির্মলেন্দু গুণকে কি করি? মনে পড়ছে না। গুণদার সঙ্গে নেক্সট দেখা হলে করে নেবো। নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন কবি-লেখককেও কদমবুচি করি। করি সম্মানার্থে। করার আরো একটি কারণ আছে : কদমবুচি সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কেন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই? কারণ এটা আমাদের সংস্কৃতি। উগ্রপন্থি হেফাজতিদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে সাংস্কৃতিক লড়াইও জারি রাখতে হবে। আমি লড়াইটা জারি রেখেছি, রাখবো। বন্ধু সামসুল আমীনের শেয়ার নেওয়া এক ভিডিওতে দেখলাম, এক মৌলভি ফতোয়া দিচ্ছে ঈদে কোলাকুলি করা নাকি বেদায়াত। কোলাকুলি করা যাবে না। নিষেধ। এই ফতোয়া শুনে রীতিমতো অবাক হলাম। হুট করে আবার নতুন ফতোয়াবাজি! কোলাকুলির কথা নাকি কোরান-হাদিসে নেই।
কোরান-হাদিসে নেই মানেই বেদায়াত। করা যাবে না। কদিন পরে বলবে হ্যান্ডশেকও করা যাবে না। ওটাও বেদাত। তারপর বলবে কারো সঙ্গে কারো দেখা হলে ‘কেমন আছেন’ বলা যাবে না। কারণ ‘কেমন আছেন’ কুরআন-হাদিসে নেই। তা বাবা কুরআন-হাদিসে তো ভাতের কথা নেই, আমের কথা নেই, মিনারেল ওয়াটারের কথা নেই। নাই বলে কি ভাত খাওয়া, আম খাওয়া, মিনারেল ওয়াটার খাওয়া বেদাত? বন্ধ করে দিতে হবে? কদমবুচি, কোলাকুলি আমাদের সংস্কৃতি। নব্য ওয়াহাবি ফতোয়াবাজরা এই সংস্কৃতি বিলুপ্ত করতে চায়। বাঙালি সংস্কৃতির সমস্ত অবলেশ তারা মুছে দিতে চায়। এই সংস্কৃতিকে তাদের খুব ভয়। ফতোয়াবাজদের বিলুপ্ত করতে বেশি বেশি কদমবুচি এবং কোলাকুলি করা আবশ্যক। এটাও সাংস্কৃতিক লড়াই। তবে আপাতত নয়, করোনাকালের পর। লেখক : কথাসাহিত্যিক