পান্থ রহমান: অনেকদিন ধরেই ফেসবুকে আমি অনিয়মিত, শুধু লাইক-কমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম। আজ পারছি না। লিখতে হচ্ছে। শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আমি নিজেও একজন চোর। তথ্য চোর। সাংবাদিক মানেই ‘তথ্য চোর’। সমস্যা হচ্ছে সাংবাদিক নিজের স্বার্থে তথ্য চুরি করে না, জনগণের স্বার্থে করে। পাঠক-দর্শক-স্রোতা সর্বোপরি জনগণকে তথ্য জানাতেই কখনো-সখনো আমাদের চুরি করতে হয়। সেই চুরি কখনো নিজে করি, কখনো সোর্সের মাধ্যমে। আপনার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, জাতির বিবেক বলে পরিচিত সাংবাদিক কেন ‘চোর’ হবেন? উত্তরটা দেওয়ার আগে চলুন সাংবাদিকের কাজ সম্পর্কে জানি।
সাংবাদিকের কাজ কী? সমাজের যে তথ্যটা সহজলভ্য নয় সেটা মানুষের সামনে নিয়ে আসাটাই সাংবাদিকের কাজ। যে তথ্যটা জরুরি কিন্তু গোপন করে রাখার চেষ্টা হয়, যে তথ্যটায় অনিয়ম দুর্নীতি কিংবা অন্যায়ের ঘটনা জড়িয়ে সেটা তুলে ধরতে চেষ্টা করেন সাংবাদিক। সেক্ষেত্রে আপনার কী মনে হয়- যে সমাজ, সংস্থা, সংগঠন, জোট কিংবা প্রতিষ্ঠানে অন্যায় হচ্ছে তারা কী নিজেরা এসে নিজেদের অনিয়মের কথা সাংবাদিককে জানিয়ে যাবেন? এমনটা আশা করেন কী? নিশ্চয়ই নয়। আর তখন সেই তথ্য পেতে সাংবাদিকদের কৌশলী হতে হয়। কখনো একে-ওকে (পড়ুন সোর্স) নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিংবা সম্পর্কের খাতিরে তথ্য যোগার করতে হয়। যিনি বা যে সোর্স ওই তথ্যটা জোগাড় করে দেন, তিনিও তো লুকিয়েই (চুরি করে) তথ্যটা এনে দেন। আর যখন সেটাও সম্ভব হয় না, তখন সাংবাদিক নিজেই কাজটা করেন। আমিও অনেকবার করেছি। না, আমি ‘চুরি’ জাষ্টিফাই করার চেষ্টা করছি না। শুধু এটুকুই বলতে চাইছি; তথ্য চুরির নামে যে অভিযোগ, এটা সাংবাদিকতার নিয়মিত প্র্যাকটিস। সেই আদ্দিকাল থেকেই সাংবাদিকতায় তথ্য সংগ্রহের এই প্র্যাকটিস চলে আসছে। ফলে যতোদিন ধরে সংবাদ মাধ্যম আছে, ঠিক যেদিন থেকে পৃথিবীতে সাংবাদিকতা শুরু হয়েছে সেই দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল সাংবাদিকই ‘চোর’; তথ্য চোর। এখন কথা হচ্ছে, সাংবাদিকের তথ্য চুরির প্রয়োজন পরে কেন?
কারণ রাষ্ট্রের সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই চান না তথ্যগুলো সাধারণ মানুষের কাছে যাক। কিন্তু কেন? নিশ্চয়ই সেই তথ্যে এমন কিছু থাকে যার সঙ্গে নিয়ম-নৈতিকতা কিংবা আইন বা নীতির পরিপন্থি কোন বিষয় জড়িয়ে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনার সূতিকাগার বলে পরিচিত ‘সচিবালয়’, যার কাজ হওয়ার কথা দেশের জনগণের পক্ষে, জনগণের কল্যাণে। সেখানে কী এমন তথ্য থাকবে যেই তথ্যটি সেই জনগণই জানতে পারবে না? সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক, করদাতা জনগণকে লুকিয়ে কী এমন হচ্ছে সেখানে? ধরে নিচ্ছি তেমনই কোনো তথ্য জোগারের চেষ্টা করছিলেন ‘চোর রোজিনা’। জনগণকে জানাতে চেয়েছিলেন, তাদের করের টাকায় আয়েশি গাড়িতে চড়ে বেড়ানো আমলারা গোপনে-গোপনে কী করতে চলেছে! ক্ষোভ তো এখানেই? (প্রমাণ সংযুক্ত, রোজিনার সর্বশেষ কয়েকটি রিপোর্ট) এখন আরেকটি প্রশ্ন, তথ্য প্রাপ্তির জন্য ‘তথ্য অধিকার আইন’ তো আছে। তবে কেন চুরি করতে হবে? কিন্তু জনাব, তথ্য চাইলে এটা-ওটা করে সেই তথ্য হাতে আসবে পনেরো দিন পর। ততোদিন হয়তো সেই সংবাদের যৌক্তিকতাই থাকবে না। যা হোক, এবার আসুন একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।
দেশের সবচাইতে ‘মেধাবী’ এবং ‘জ্ঞানী’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত ‘আমলা’ জনগোষ্ঠী তাদের অভিযোগে রোজিনা ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘জনৈক’ নারী হিসেবে। বেশ! পরিচয় জানার পরও রোজিনা ইসলামকে ক্ষুদ্রার্থে দেখার চেষ্টাকে কীভাবে দেখা যায়; তার অজ্ঞতা? কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব, তিনি তো দেশের সবচাইতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের মানুষ (বিসিএস ক্যাডার), তার অজ্ঞতা হয় কী করে? তাহলে ধরেই নেওয়া যায়, এটা জেশচারের সমস্যা। স্কুলিংয়ের সমস্যা। পারিবারিক, সামাজিক শিক্ষার অভাব। তবে কী এখন রাষ্ট্র তারাই চালাচ্ছেন, যারা পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষায় পুরোপুরি শিক্ষিত নন। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না। কেননা, আমি অনেক আমলাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাদের পারিবারিক শিক্ষা সম্পর্কে জানি। তাদের দু’একজন আমার পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তাহলে? তাহলে কী ওই অভিযোগটা সত্য? বাজারের গাইড বই আর মুখস্ত বিদ্যার জোড়ে মেধাবী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইদানিং ‘যে কেউ’ ঢুকে যাচ্ছে। সত্যিকারের শিক্ষা না পাওয়া সেই মানুষগুলোর জন্য আমার সত্যিই মায়া হয়। কিন্তু কী আর করা, তারাই তো দেশ চালাচ্ছেন। তারাই তো দেশ চালান।... বর্তমান সরকারের এতো এতো অর্জনকে নষ্ট করার জন্য এমন দু’চারটে স্বল্প শিক্ষিতই যথেষ্ট। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। ফেসবুক থেকে