চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের পাশাপাশি চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় বেশকিছু তথ্য ও টাকা লেনদেনের প্রমাণ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইর কাছে এসেছে। এসব তথ্য প্রমাণ থেকে খুনের সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও উঠে আসছে। তবে হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে গত চার দিনেও মুখ খোলেননি তিনি। তার পাঁচ দিনের রিমান্ড আজ সোমবার শেষ হচ্ছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, রিমান্ড শেষে আগামীকাল (সোমবার) বাবুল আক্তারকে আদালতে হাজির করা হবে। আরও তথ্য জানার প্রয়োজন থাকলে আমরা নতুন করে আদালতে তার রিমান্ডের আবেদন করব।
গত ১৩ মে থেকে পিবিআই কর্মকর্তারা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন বাবুল আক্তারকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমান্ডে মুখ খোলেননি বাবুল আক্তার। উল্টো তিনি পিবিআই সদস্যদের ধমকের সুরে কথা বলছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে বাবুল আক্তার বলেছেন, মাই নার্ব ইজ ভেরি স্ট্রং। পারলে তোমরা আমার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি করাও।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশে চাকরি করার সময় তিনি যেভাবে দাম্ভিকতা দেখাতেন, রিমান্ডেও সেভাবেই আচরণের চেষ্টা করছেন। আমরাও কৌশল বদলাচ্ছি। গত ১১ মে মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় তার স্বামী ও মামলার বাদী বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখায় পিবিআই। ১২ মে তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রী হত্যার ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেন। জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দীর্ঘদিনের তদন্ত শেষে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। ঘটনার সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হন পিবিআইর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পরদিন আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় বাবুল আক্তারের মামলার।
এর পর মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে নতুনভাবে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আরও সাতজন আসামি আছেন। তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা সিকদার, এহতেশামুল হক ভোলা ওরফে হানিফুল হক ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাক্কু সিকদার এবং শাহজাহান মিয়া। এ মামলাটিও পিবিআই তদন্ত করছে।
মিতু হত্যার পরপরই রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর এলাকায় পরিত্যক্ত ইটভাটা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত হন। তারা হলেন নুরুন্নবী ও রাশেদ। এ ছাড়া মামলার আরও দুই আসামি শুরু থেকেই পলাতক আছেন। তারা হলেন মামলার দ্বিতীয় আসামি মুসা সিকদার ও ছয় নম্বর আসামি খায়রুল ইসলাম কালু।
মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন মামলার এজাহারে দাবি করেন, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এক নারীর সঙ্গে বিয়েবহির্র্ভূত অনৈতিক সম্পর্কের জেরে দাম্পত্য কলহ থেকেই মিতুকে খুন করিয়েছেন বাবুল আক্তার। পিবিআই ইতোমধ্যে বাবুল আক্তার এবং গায়ত্রী অমর সিং নামের ভারতীয় ওই নারীর মধ্যে সম্পর্কের কিছু তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়েছে। বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ, কক্সবাজারে ওই নারীর কর্মস্থলে গিয়ে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ এবং তিনি বাংলাদেশে আছেন কি নেই এ বিষয়ে তদন্ত ও সর্বশেষ তার সঙ্গে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে খুনের কারণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত হতে চায় পিবিআই।
কে এই গায়ত্রী : মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন মামলার এজাহারে অভিযোগ করেন, কক্সবাজারে কর্মরত থাকাকালে বাবুল আক্তার এনজিও কর্মকর্তা ভারতীয় নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। বিষয়টি জেনে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে বাবুলের দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার মিতুকে খুনের পরিকল্পনা করেন এবং সহযোগীদের নির্দেশ দিয়ে মিতুকে খুন করান।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে বাবুল আক্তার কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে গায়ত্রী ইউএনএইচসিআরের ফিল্ড অফিসার (প্রটেকশন) হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। তখন বাবুল আক্তার গায়ত্রীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
জানা যায়, গায়ত্রী অমর সিং মানবপাচার নিয়ে কাজ করতেন। এ কাজ করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। সে সময় ওই বিষয়ে একে অপরকে নানা তথ্য দিয়েও সহযোগিতা করেন।
২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাবুল আক্তার দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের মিশনে ছিলেন। তখন তিনি নিজের ব্যবহারের মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে যান। গায়ত্রী ওই মোবাইল নম্বরে বিভিন্ন সময়ে ২৯টি মেসেজ পাঠান। মেসেজগুলো মিতু একটি খাতায় লিখে রাখেন। হত্যাকা-ের কয়েকমাস আগে বাবুল আক্তার চীনে যান প্রশিক্ষণের জন্য। তখন বাবুল আক্তারকে গায়ত্রীর উপহার দেওয়া ‘তালিবান’ ও ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ নামে দুটি বই খুঁজে পান মিতু। তালিবান বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রীর নিজ হাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, ০৫/১০/১৩, Coxbazar, Bangladesh. Hope the memory of my offering you this personal gift, shall etemalize our wonderfull bound, love you, Gaitree.
একই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় (২৭৬ নম্বরের পরের পাতায়) বাবুল আক্তারের নিজের হাতে লেখায় গায়ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ আছে। এজাহারে উল্লেখ আছে, ‘সেখানে লেখা আছে, First meet 11 sep 2013, First PR Cox 7 oct 2013, G Birthday, 10th October, First (--) 5 oct 2013, Fist Beach Walk: 8 oct 2013, 11 oct 2013, Mermaid with family, 12 oct 2013, Temple Ramu Prayed together. 13 oct 2013 Ramu Rubber Garden, Chakaria night beach walk. এ ছাড়া ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ বইটির প্রথম দিকের দ্বিতীয় পাতায় গায়ত্রীর নিজ হাতে ইংরেজিতে লেখা আছে 05/1-/2-13, with my sincere love, Yours Gaitree. গায়ত্রী চাকরিসূত্রে বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থান করছেন বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গায়ত্রীর ২৯টি মেসেজ লেখা মিতুর খাতা এবং বাবুলকে উপহার হিসেবে দেওয়া দুটি বই আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পিবিআই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, মেসেজগুলো গায়ত্রীর কিনা এবং বইয়ে যেসব হাতের লেখা আছে সেগুলো বাবুল আক্তারের কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বাবুল আক্তারকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিষয়টি নিশ্চিতে প্রযুক্তিরও ব্যবহার করা হবে।
মোশাররফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মিতু বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোনে প্রথম গায়ত্রীর মেসেজ পায়। পরে দুটি বইয়েও নানা কথাবার্তা দেখতে পায়। এসব নিয়ে তাদের দাম্পত্য কলহ-অশান্তি চরমে ওঠে। বাবুল তাকে বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। মিতু বেশ কয়েকবার আমাদের বিষয়গুলো জানিয়েছিল। আমরা মনে করেছিলাম সংসারে এসব হয়ে থাকে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় মামলা সম্পর্কে মিতুর বাবার বক্তব্য : মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরাও সবার মতো বাবুল আক্তারকে বিশ্বাস করেছিলাম। সে খুন করতে পারে এটা প্রথমে ভাবতেই পারিনি। আর যেহেতু একটি মামলা দায়ের হয়েছিল, একই ঘটনায়তো দুটি মামলা হতে পারে না। সে জন্য আমি তখন মামলা করতে পারিনি। পরে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই আমাকে জানিয়েছে, হত্যাকা-ে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তারা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। আইনে বলা আছে, কোনো মামলায় ঘটনার সঙ্গে বাদীর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেলে পুলিশ সুয়ামোটো মামলা করতে পারে, অথবা বিচারপ্রার্থীর স্বজন করতে পারে। সে হিসেবে আমি মামলা করেছি।
টাকা লেনদেনের খবর : গত ১১ মে বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠজন ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হক এবং তার ঘনিষ্ঠজন গাজী আল মামুন আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সাইফুল হক বলেন, মিতু হত্যার তিন দিন পর বাবুল আক্তারের নির্দেশে গাজী আল মামুনের মাধ্যমে তিনি মুসা সিকদারকে তিন লাখ টাকা দেন। পিবিআই, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান জানিয়েছেন, একটি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ তারা পেয়েছেন। সাইফুল ও মামুনের জবানবন্দি এবং টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর মোটামুটিভাবে হত্যাকা-ের সঙ্গে বাবুল আক্তারের একটা যোগসূত্র থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এর আগে ঢাকায় পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঘটনাস্থলের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভির ফুটেজে একজনকে দেখা গিয়েছিল। পরে জানা যায় সে বাবুল আক্তারের ‘সোর্স’ মুসা সিকদার। ভিডিও ফুটেজ স্পষ্ট মুসাকে চেনা গেলেও জিজ্ঞাসাবাদে মুসাকে নিয়ে বাবুল আক্তার কোনো সন্দেহের কথা বলেনি। পরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি বাবুল আক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে তার ব্যক্তিগত সোর্স মুসাকে নিয়ে পুলিশকে কিছু জানাননি।
দুই আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো : মাহমুদ খানম মিতু হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া নতুন মামলায় কারাগারে থাকা দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদের নাম মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম এবং আনোয়ার হোসেন। দুজনই বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলায় কারাগারে আছেন, যে মামলা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে নিষ্পত্তি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
নতুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই, চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা আদালতে দু’জনকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন। গতকাল রবিবার শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফী উদ্দিন তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য পিবিআইকে অনুমতি দেন।
আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারাগারে আছেন। মিতু হত্যার পর ২০১৬ সালের ২৬ জুন আনোয়ার ও ওয়াসিমকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, মিতু হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি তাদের এহতেশামুল হক ভোলা দিয়েছিলেন। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ভোলাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
এ নিয়ে মিতু হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া নতুন মামলায় বাবুল আক্তারসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হল। চারজনই নতুন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলায় ওয়াসিম ও আনোয়ারের সঙ্গে শাহজাহান নামে আরও একজন কারাগারে আছেন। তিনজনই নতুন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। কারাগারে থাকা শাহজাহানকে আগামীকাল গ্রেপ্তারের জন্য আবেদন করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরে আদালতে তাদেরও রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে।