অনলাইন ডেস্ক: প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনা, স্কুলের ছুটির পর বন্ধুদের সাথে মালাই আইসক্রীম খান সিলেটের তানভীর শাহরিয়ার রিমন। পকেটে টাকা না থাকায় বাকীতেই খেতে দিয়েছিলো সেই আইসক্রীম বিক্রেতা। পরে মনে না থাকায় সেই টাকা আর পরিশোধ করা হয়নি রিমনের । তবে মনের মধ্যে জমে থাকা পাপবোধ ভাবিয়েছে রিমনকে। অনেক খোঁজাখুজির পর, বাল্য বন্ধুদের সহায়তায় খোঁজ পাওয়া গেছে সেই আইসক্রীম বিক্রেতার, তবে এর মাঝে কেটে গেছে ৩০ টা বছর। রিমনের ভাষায়, ‘বুকে জমে যাওয়া বরফটা গলে গিয়েছে, এখন বুকটা হালকা লাগছে’।
এই ঘটনার পর নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সিলেটের স্বনামধন্য এই ব্যবসায়ী। আমাদের সময়. কমের পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক পোস্টটি দেয়া হলো:
প্রায় দুসপ্তাহ আগে সিলেট থেকে আমার সাবেক রেস্টুরেন্ট কর্মী আলামিনের ফোন পাওয়ার পর ৩০ বছর আগে মালাই আইসক্রিম বাকিতে খেয়ে টাকা দিতে না পারার যে কষ্ট তা আবার নতুন করে বুকে বরফের মতো জমে গিয়েছিল । আলহামদুলিল্লাহ গতকাল সেই বরফটা গলেছে । খুব হাল্কা লাগছে বুকটা ।
আমার ফেসবুক পোস্ট পড়ে ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার ৩০ বছর আগের কয়েকজন বাল্যবন্ধুরা নেমে পড়েন সেই আইসক্রিম বিক্রেতার খোঁজে । ওই সব বন্ধুদের একজন অস্ট্রেলিয়ায় থাকে । সেই আমাকে প্রথমে বলে-চিন্তা করিস না, বল্টু মামার খোঁজ নিয়ে দিচ্ছি ।
-বল্টু মামা ? উনার নাম কি বল্টু মামা ছিল ?
-ক্যান তোর মনে নাই, আমার বন্ধুটি পাল্টা জিজ্ঞেস করে ।
-না রে, স্পষ্ট কিছুই মনে নাই । সব ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে । আইসক্রিম বাকিতে খেয়েছি এটা মনে আছে । তারপর আর টাকা দিতে মনে ছিলনা । বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ব্রাক্ষনবাড়ীয়া ছেড়ে চলে যাই ছোটবেলায় । বড় হয়ে বার কয়েক উনার কথা ভেবেছি । কিন্তু আলামিনের ফোন আমাকে অস্থির করে তুলেছে । তুই যেমনে পারিস হেল্প কর ।
এর মাঝে আরেক বাল্য বন্ধু যে বর্তমানে ঢাকায় থাকে (আমার সাথে ফেসবুকে যু্ক্ত হয়েছে মাস তিনেক হলো ) আমাকে ইনবক্স করল ৩/৪ দিন আগে । বল্টু মামার খোঁজ পাইছি । এখন আর আইসক্রিম বেচেননা উনি । তবে মুরি চানাচুর বেচেন । বুড়া হয়ে গেছেন । নাসিরনগরে থাকেন । আমি মোবাইল নাম্বার নিয়ে তোকে দিচ্ছি ।
নাম্বারের জন্য অপেক্ষা শুরু হয় আমার । নাম্বার তো আর আসেনা । অবশেষে গতকাল সেই নাম্বার পেলাম ।
নাম্বার পেয়েই মামা কে ফোন দিলাম ।
-বল্টু মামা ?
-হ কইতাছি ?
-মামা আমারে চিনবেন না । আমি আপনাকে চিনি । আপনি আইসক্রিম বিক্রি করতেন স্কুলের সামনে ।
-হ বেচতাম তো । ইতা তো বউত দিন আগর কথা । (মামা চুনারুঘাটের ভাষায় কথা বলতে থাকেন )
-জি মামা । ৩০ বছর আগে আপনি আমাকে আইসক্রিম খেতে দিছিলেন বাকিতে । সেই টাকাটা আর আপনাকে দিতে পারিনাই মামা । ছোট ছিলাম । অত কিছু বুঝতাম না মামা ।
-হাছা কইতাছনি ? আমি মনে করতাম পারতাছিনা । বাবারে আমারতো দাবি নাই ।
-মামা , দাবি নাই জানি । তারপরও মামা আমি আপনাকে একটু ঈদ উপহার দিতে চাই ।আপনার বিকাশ নাম্বারটা কী দেবেন ?
-কিতারলাইগ্গা রে বাবা । আমি তো কইলাম আমার দাবী নাই। ।
-মামা, লক্ষ্মী মামা আমার । একটা বিকাশ নাম্বার দেন মামা ।
-আইচ্ছা আমার ছেলের সাথে কথা কইলাও ।
মামা তার ছেলেকে ফোনটা দেন ।
-ভাই কি নাম আপনার ?
-প্রশান্ত দাশ ।
প্রশান্ত দাদাকে আমি ঘটনা খুলে বললাম। । দাদা আমাকে তার বিকাশ নাম্বার দিলেন ।
আমি তার বিকাশ নাম্বারে বল্টু মামার জন্য ঈদ উপহার পাঠালাম ।
একটু পরই প্রশান্ত দাদা ফোন দিলেন ।
-দাদা, বাবায় খুব খুশী অইছন । আফনার লাইগ্যা দোয়া করবা কইছইন ।
-প্রশান্ত দা, আপনি মামাকে বলবেন, একদিন মুরি চানাচুর খাইতে আসব কিন্তু ।
আমি খুশী মনে ফোন কেটে দিই । এই পুরা ঘটনা গাড়িতে বসে অবজার্ভ করছিল আমার ব্যক্তিগত গাড়ীর চালক ইব্রাহিম ।
-স্যার, এতো বছর আগের কথা আপনার মনে আছে ? মানুষ তো কালকের কথাই ভুলে যায়, ইব্রাহিম বলে ।
-ইব্রাহিম, আমিও প্রায় ভুলেই গেছিলাম । তবে দুসপ্তাহ আগে একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে আলামিন আমাকে মনে করিয়ে দিছে । আমার কোনো ক্রেডিট নাই । সব ক্রেডিট আলামিনের ।
যে আমার বুকে জমাট বেধে যাওয়া বরফ গলাতে নিজের অজান্তেই সাহায্য করেছে সেই আলামিনকে ফোন করে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার । আমি আলামিনকে ফোন দিই ।
-আলামিন তুমি জাননা, তুমি খত বড় উফখার খরছো আমার ।
-কিতা খরছি স্যার ?
-তুমি আমার বুকর উফরে তাকি এখটা বড় পাথ্থর নামাই দিছ।
-ই কিতা খইন স্যার ।
-অয়বা । হাসা খইয়ার ।
তারপর তার পালমুনারি স্টেনসিস রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে কিছু কথা বার্তা হয় ।
আলামিনের সাথে কথা শেষ করে হঠাৎ করেই আমার মন ফুরফুরে হয়ে যায় । এই ফুরফুরে মেজাজে একটা গীতি কবিতার কয়েকটা লাইন খুব মনে পড়ে যায় । আমি গুনগুন করতে থাকি-
❝ দেখো আলোয় আলো আকাশ,
দেখো আকাশ তারায় ভরা
ভরে থাকুক আমার মুঠো,
দুই চোখে থাকুক ধারা... ❞
আমি অনুভব করি, আনন্দে আমার দুই চোখ ভিজে উঠছে...!