আরমান কবীর: [২] করোনা ভাইরাসে থাবায় সারাদেশের মতো থমকে গেছে টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়ার যৌনপল্লী। লম্বা সময় জনজীবন স্বাভাবিক না থাকায় এখানকার যৌন কর্মীদের দুর্দিন চলছে। অর্ধহারে-অনাহারে চলছে তাদের নিত্যদিন। উপার্জন না থাকায় কেউ কেউ পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। একদিকে করোনা অন্যদিকে করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে লকডাউন। উভয়টি যৌনকর্মীদের জন্য দুর্দিন ডেকে এনেছে।
[৩] দীর্ঘ ১২ বছর যাবত টাঙ্গাইল যৌন পল্লীতে বসবাস করেন আশা আক্তার (২৭)। আগে প্রতিদিন ৮০০-১২০০ টাকা আয় করতেন। করোনাভাইরাসের কারণে খদ্দের কম থাকায় প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো। এখান থেকে যা আয় করতেন তা দিয়ে ঘর ভাড়া, সন্তানের খরচ, খাবার ও ব্যক্তি খরচ বাদ দিয়ে তার বাড়িতে টাকা পাঠাতেন।
[৪] প্রায় ১৩ মাস যাবত করোনাভাইরাসের কারণে খদ্দের সংখ্যা কম। সর্বশেষ দুই সপ্তাহ যাবত লকডাউনের কারণে খদ্দের একেবারেই নেই। খদ্দের না আসায় আয় উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। লজ্জার কারণে সমাজের কারো কাছে হাত পাততেও পারছেন না। সব মিলিয়ে তিনি এখন অর্ধহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শুধু আশা আক্তার নয়। তার মতো টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়া যৌন পল্লীর প্রায় ৭০০ কর্মী খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। আবার অনেক কর্মী ঘর ভাড়া দিতে না পাড়ায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
[৫] আশা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স দেড় বছর। মেয়ে হওয়ার পর তিন মাস ঠিক মতো দুধ ও কাপড় কিনে দিতে পেরেছি। করোনাভাইরাসে কারণে প্রায় ১৩ মাস যাবত মেয়ের নতুন জামা ও দুধ কিনে দিতে পারিনা। সুজি খাইয়ে মেয়েকে মানুষ করতে হচ্ছে। বর্তমানে সুজি কেনার টাকাও থাকে না। অন্যের কাছ থেকে টাকা চেয়ে সুজি কিনে দিতে হচ্ছে। লকডাউনে গাড়ি বন্ধ। লোকজনও আসে না। সব মিলিয়ে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এতো কষ্ট বিগত ১২ বছরেও করিনি।
[৬] জানা যায়, টাঙ্গাইল পৌর এলাকার ১১ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত ২০০ বছরের পুরোনো কান্দাপাড়া যৌন পল্লীটি ৩০২ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ৫৯টি বাড়িতে প্রায় ৭০০ যৌনকর্মী বসবাস করে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের ২০ মার্চ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি জনকে ৩০ কেজি করে চাল দিয়ে এই পল্লীকে লকডাউন ঘোষণা করে। এর পর ঈদুল ফিতরের আগে প্রতি সদস্যকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ৫০০ করে টাকা দেওয়া হয়।
[৭] শনিবার (২৪)দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লকডাউনের কারণে কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর প্রতিটি অলিগলির রাস্তা ফাঁকা। যৌনকর্মী ছাড়া আর কেউ নেই ওই এলাকায়। আবার অনেকেই কক্ষ ছেড়ে দেওয়ায় বাড়িতে তালা ঝুলানো দেখা গেছে। এ প্রতিবেদকের ব্যাগ ও হাতে খাতা কলম দেখে কয়েকজন যৌন কর্মী এগিয়ে আসেন ত্রাণ সামগ্রীর পাওয়ার আশায়। ত্রাণ সামগ্রীর জন্য কয়েকজন তাদের নাম আগে লিখতে বলেন।
[৮] সীমা আক্তার (৩৫) বলেন, ‘খদ্দের না থাকায় কষ্ট বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। চোখের লজ্জায় কারো কাছে অভাবের কথা বলতেও পারি না। ঘরে খাবার না থাকায় প্রথম দুটি রোযা চাল পানি খেয়ে সেহরী ও ইফতার করেছি। আয় রোজগার না থাকায় পল্লীর ভিতরের সদস্যদের কাছ থেকে তাদের পুরাতন জামা কাপড় এনে পড়ছি।’
সুমি আক্তার বলেন, ‘দেহ ব্যবসা ছাড়া অন্য কোন কাজ শিখিওনি পারিও না। এই কাজ করে নিজের সব খরচের পাশাপাশি বাড়ির বৃদ্ধা বাবা মায়ের ওষুধ কেনার জন্য মাসে সাড়ে তিন হাজার করে টাকা দিতে হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত তাদের টাকাও দিতে পারি না। তারা টাকা চেয়ে কান্না করে। আমি টাকা না দিতে পেরে কান্না করি। সরকারি কোন সহযোগিতা পেলে রোজার মাসটা কোনভাবে কাটাতে পারতাম।’
[৯] বিউটি আক্তার বলেন, ‘আগে প্রায় প্রতি মাসে একবার করে নতুন কাপড় কিনতাম। এক বছর যাবত নতুন কাপড় কিনতে পারি না। আগের কাপড় দিয়েই চলতে হচ্ছে। আগামী ঈদেও নতুন কাপড় কিনতে পারবো কি না তাও জানি না।’
[১০] নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী নেত্রী বলেন, ‘শুধু কর্মীরা মানবেতর জীবন যাপনই করছে না। আমরাও খুব কষ্টে দিন পার করছি। করোনাভাইরাসে ভয়ে এমনিতেই মানুষ আসে না। লকডাউনের কারণে আরো আসে না। সব মিলিয়ে খুব কষ্টে আছি।’
[১১] নারী মুক্তি সংঘের আকলিমা আক্তার আখি বলেন, ‘এই যৌন পল্লীর সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। লকডাউনের কারণে খদ্দের না থাকায় বাড়ি ভাড়া, খাবার খরচসহ ব্যক্তিগত খরচ যোগাতে না পেরে প্রায় ৫০ জন কর্মী তাদের বাড়িতে চলে গেছে।
[১২] ’বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তাবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আজাদ বলেন, ‘লকডাউনের জন্য অন্যান্য পেশার মতো যৌন কর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কাজেই যৌনকর্মীসহ অন্যান্য পেশাজীবিদের মানবিক কারণে সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
[১৩] ’টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বলেন, ‘যৌন পল্লীসহ অন্যান্য পেশার যারা মানবেতর জীবন যাপন করছে সরকারিভাবে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।
[৪] ’টাঙ্গাইল-৫ আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বলেন, লকডাউন যেহেতু দীর্ঘ হচ্ছে যৌন কর্মীসহ আরো যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাদের মধ্যে গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) থেকে প্রাথমিকভাবে ইফতার সামগ্রী পরিবেশন করা হচ্ছে। এ ছাড়াও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ারও প্রস্তুটি চলছে বলে তিনি জানান।