আরিফ জেবতিক: কোভিড সহজে যাচ্ছে না, এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে কোভিড নিয়ন্ত্রণে সামাজিক পদক্ষেপগুলো নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের বেশ কিছু গবেষণা এবং ডাটা ট্রেসিং এখন মহাজরুরি বিষয়। যেমন ধরা যাক, গার্মেন্ট কারখানা কখনোই বন্ধ হয়নি, সুতরাং গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণের হার কতো, সেই ডাটা যদি আমাদের কাছে থাকতো তাহলে এ নিয়ে বিতর্ক হতো না। যদি দেখা যায় যে গত একবছরে এই শ্রমিকদের মধ্যে অসুস্থ হওয়ার হার ন্যূনতম, তাহলে কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত থাকবে, আর যদি দেখা যায় আক্রান্তের হার গড় হারের সমান বা বেশি তাহলে এই খাতেও লকডাউন কার্যকর করতে হবে। বিভিন্ন গ্রুপ ও পেশাভিত্তিক প্রচুর ডাটা সংগ্রহ করা না গেলে এবং সেই ডাটা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত না নিয়ে ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’ হলে অর্থনীতিতে এর চাপ বেশি পড়বে। পাঠাও এর মোট রাইড কয়টি এবং সেই যাত্রীদের কতো শতাংশ আক্রান্ত, এ ধরনের সব তথ্য দরকার। বর্তমান বাস্তবতায় আপাতত ১ সপ্তাহের লকডাউন একটা ভালো সিদ্ধান্ত, যদিও ২ সপ্তাহের ‘কঠোর লকডাউন’ দেওয়া গেলে সংক্রমণ খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতো, কিন্তু আমাদের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ১ সপ্তাহের লকডাউনেও টিকে থাকা বড় মুশকিল হয়ে যাবে।
কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে কোনো যৌক্তিক কারণটা ধরতে পারিনি। যেমন কাঁচাবাজার তো সবারই লাগবে, সেই কাঁচাবাজার খোলা রাখার সময় কেন সংক্ষিপ্ত করতে হবে? সময় সংক্ষিপ্ত করলে সবাই একই সময়ে গিয়ে ভিড় করবে, যাতে ঝুঁকি বেশি। বরং কাঁচাবাজার, ব্যাংক (যখন খুলবে আর কি) বা এরকম প্রয়োজনীয় সার্ভিসের বেলা সময়টা সাধারণ সময়ের চাইতে কম তো নয়ই বরং বেশি করা দরকার। একাধিক শিফট করা যেতে পারে। যদি কাঁচাবাজার রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে, তাহলে আমি তারাবির নামাজের পরেই গিয়ে বাজার করবো, বিকেল ৩টার সময় গিয়ে ভিড় করবো না। সেক্ষেত্রে মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলে ভিড় কম হবে, ঝুঁকি কমবে। স্বীকার করতে হবে যে মাঝখানে আমরা সবাই গা ঢিলা দিয়ে বসেছিলাম, আজকের কোভিড সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে এটাই বড় কারণ। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই শারিরীক উপস্থিতির বিকল্পগুলো অফার করতে পারেনি, অথচ এতোদিনে এগুলো ডেভেলপ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। গেমস, ভর্তি পরীক্ষা, বইমেলা-এগুলো অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব নেওয়ার কারণেই আজকে অবস্থা খারাপ। খালি পাবলিককে ‘মাস্ক পরে না’ বলে গালি দেওয়ার আগে এদিকটাও আলোচনায় আনা দরকার। আগামী একবছরের জন্য একটি ছায়া নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। ‘ঠেকায় পড়ে’ সময়ে সময়ে সিদ্ধান্ত না নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই খানিকটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যাওয়া দরকার।
কিছু কিছু জিনিস চিরকালের জন্যই বদলে ফেলা ভালো। যদি ফৌজদারি কোর্টের জামিন শুনানি অনলাইনে চলতে পারে, তাহলে দেওয়ানি মামলাগুলো তো আরো সহজে অনলাইনে আসতে পারে। আর সেই অনলাইন দেওয়ানি আদালতকে স্থায়ী করে ফেলা যেতে পারে, আমার দাদার জমি নিয়ে করা মামলার কারণে আমাকে কেন কোর্টের বারান্দায় গিয়ে ভিড় বাড়াতে হবে? এটি একটি উদাহরণ মাত্র, নিশ্চয়ই অনেক বিষয়েই এটা করা সম্ভব। দরকার শুধু ভালো করে পরিকল্পনা এবং সেই অনুযায়ী অবকাঠামোর উন্নয়ন, মানসিকতা পরিবর্তন। যাই হোক, সবচাইতে হাসি পেয়েছে যে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা নাকি ‘সীমিত আকারে’ হবে। এখানে শোভাযাত্রাটা বড় নয়, কিন্তু যে সিগনাল মানুষকে দেওয়া হচ্ছে সেটা বড়। আপনি সীমিতাকারে শোভাযাত্রা করবেন তো আরেকজনকে বরযাত্রা করতে নিষেধ করার নৈতিক অবস্থান হারাবেন। অবজেক্টিভ নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী কাজ না করলে সবকিছু শেষ পর্যন্ত এভাবে একটা লেজেগোবরে অবস্থায়ই এগুতে থাকবে। মুশকিল বটে! লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক