মারুফ রসূল: এই যে সময়-সুযোগ-সুবিধা মতো হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকসহ অন্যান্য নেতারা বয়ান বদলে ফেলেন, ধর্মকে সামনে রেখে নিজেদের আখের গোছানোর রাজনীতি করেন- এই স্বভাব তারা উত্তরাধিকারসূত্রেই লাভ করেছেন। কেবল স্বাধীন বাংলাদেশে নয়, সাতচল্লিশ-পূর্ব ভারতবর্ষেও ধর্মের নামে রাজনীতি করা কাঠমোল্লারা নিজেদের সুবিধা মতো বয়ান তৈরি করেছে এবং ধর্মের নামে সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে বিতরণ করেছে।
১৯৪১ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মওদুদীর নেতৃত্বে যখন জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনও তারা নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিশেবেই ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পরপরই তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে এবং সেটাও সুবিধাবাদী তরিকায়। যেমন মওদুদী পাকিস্তানকে আখ্যা দিয়েছিলো ‘আহাম্মকের বেহেশত’ আর ‘মুসলমানদের কাফেরানা রাষ্ট্র’ হিশেবে (সূত্র: তরজুমানুল কোরান, ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৩)। জিন্নাহ সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিলো, ‘এই ব্যক্তির ত্রুটি বর্ণনা করে শেষ করা যায় না’ (সূত্র: তরজুমানুল কোরান, জুন, ১৯৪৮, পৃ. ৭০)। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর এই মওদুদীই কিন্তু ভারতের পাঠানকোট ছেড়ে পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন আবার নতুন কথা বলতে শুরু করে। তার ভাষায় পাকিস্তান তখন ‘খোদাদাদ’Ñ অর্থাৎ আল্লাহর দান স্বরূপ। শুধু তাই নয়, আগের বইগুলোতে যেখানে সে পাকিস্তানের সমালোচনা করেছিলো, সেগুলো বাদ দিয়ে নতুনভাবে বইগুলো প্রকাশ করা শুরু করে। যেমন মওদুদীর লেখা সিয়াসী কসমকসের তৃতীয় খণ্ডের ১৩৭ নম্বর পৃষ্ঠায় মুসলিম লীগ সম্পর্কে বলা হয়েছিলো, ‘লীগের কায়েদে আজম থেকে শুরু করে কেউই মুসলমানের অর্থ পর্যন্ত জানে না’। কিন্তু ১৯৫৫ সালে লাহোর থেকে যখন এই বইটিরই সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তখন এই বাক্যগুলো ফেলে দেয়া হয়েছিলো; যদিও ভূমিকাতে লেখা ছিলো— ‘কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন ছাড়াই পূর্ববৎ প্রকাশ করা হইল’।
হেফাজতে ইসলামের কায়-কারবারও একই ধরনের। হওয়াটাই স্বাভাবিক; কেননা, আগেও বলেছি, এখনও বলি- হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে জামায়াতে ইসলামের ভাড়া খাটা সংগঠন। ওই ভাড়া খাটার জন্যই তার জন্ম। নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ ঘোষণা করেও তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে থাকে এবং অবশ্যই সেটা নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। ভণ্ড মামুনুল হক যে ‘সত্য গোপনের তরিকা’ বাতলেছিলো, সেটাও মওদুদীর ধারাবাহিকতা। কারণ মওদুদীর ফতোয়াতেই আছে, ‘সময় সময় মিথ্যা বলা শুধু জায়েজই নয় বরং অবশ্য কর্তব্য’ (সূত্র: তরজুমানুল কোরান, মে, ১৯৫৮)।
ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করা এইসব উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সব সময়ই চেয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মকে একটি দুর্বোধ্য বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করতে। তার সঙ্গে জারি রেখেছে ভয়-ভীতি প্রদর্শন। কারণ তারা জানে, সাধারণ মানুষ যদি মাতৃভাষায় ধর্ম সম্পর্কে জানে, তাহলে তাদের ওয়াজ-খুতবা-মাহফিলের নামে যা-তা বলে বেড়ানোর দিন শেষ হয়ে যাবে। এ কারণেই জ্ঞানভিত্তিক ধর্মালোচনাকে এরা বারবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। যেমন সূফীতত্ত্বের পরিব্রাজকগণ বা আহমেদীয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন ধর্মকে জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন বলেই তাঁরা বারবার এসব কাঠমোল্লাদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন।
এসব কাঠমোল্লাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দিনশেষে ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়া বা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা। এই রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে মসজিদ-মাদ্রাসাকে তারা বহুদিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। এটুকুই এদের শক্তি। আপনি তাদের পরিচালিত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য বা দৈনিক আহারের পুষ্টিমান সম্পর্কে গবেষণা করেন, পাশাপাশি এসব মাদ্রাসার পরিচালকদের আর্থিক অবস্থাটি খুঁজে বের করেন- তাহলেই বুঝবেন আপনার দান একজন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়, নাকি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এসব ধর্মব্যবসায়ীর দৈনন্দিন বিলাসিতার জন্য ব্যবহৃত হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ক্যান্টিনের খাবারের মানের খবর গণমাধ্যমে হরহামেশাই প্রকাশিত হতো, আজ পর্যন্ত কোনো কওমি মাদ্রাসার আর্থিক বরাদ্দের বিপরীতে শিক্ষার্থীদের খাবারের মান সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন দেখলাম না। সব প্রতিষ্ঠানের অডিট হয় কিন্তু এইসব মাদ্রাসার অডিট হয় না। অথচ এইটুকু করতে পারলেই আমরা অনেকটুকু জানতে পারতাম। ফেসবুক থেকে