নিউজ ডেস্ক : দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিহীন কালবৈশাখী গাইবান্ধায় শুধু বাড়িঘর বা গাছপালাই লণ্ডভণ্ড করেনি, কেড়েছে ১২ প্রাণ। গত রবিবার দুপুরের এই ঝড়ে সদর, পলাশবাড়ী, সুন্দরগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ ও ফুলছড়ি উপজেলায় লাশের সারি দেখা গেছে। জাহানারা, সাহারা, ময়না, শিমুলী, আরজিনা, জোছনা রানী, মমতা, বাতাসী, শারমিনদের শোকে অন্ধকার দেখছে স্বজনরা। কালের কণ্ঠ
গতকাল সোমবার সকালে নানার বাড়িতে দাফন করা হয়েছে হরিণসিংহার পাঁচ বছর বয়সী শিশু মনির হোসেনকে। চোখের পানিতে ভাসছে বাবা হীরু মিয়া, বোন হ্যাপী খাতুন, হাসি খাতুন ও খুশি খাতুন। খুশি (১৪) জানাল, রবিবারই ছিল মনিরের জন্মদিন। তাদের বাবা রাজমিস্ত্রি হলেও ছেলে-মেয়েদের প্রচণ্ড ভালোবাসেন। তাই রাতে তাদের বাড়িতে ভালো খাবারের আয়োজন ছিল। দুপুরে ঝড়ের সময় বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল মনির। এ সময় একটি ইউক্যালিপটাসগাছ ভেঙে তার মাথায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় মনির। হীরু মিয়া বুক চাপড়ে বলেন, ‘ছোলটার জন্মদিন করার খুব শখ আছিল। ওক এ বছরই মাদরাসাত ভর্তি করাম ঠিক করছিলাম। সব শেষ হয়্যা গেল।’
হরিণসিংহা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরেই সদরের আরিফ খান বাসুদেবপুর গ্রাম। সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন আরজিনা বেগম। গ্রামের সবচেয়ে ভদ্র স্বভাবের ‘বউ’ হিসেবে পরিচিত আরজিনাকে একনজর দেখতে ভিড় করেছেন পুরো এলাকার নারীরা। পুরুষরা ভিড় করে আছেন আঙিনায়। জোহরের পর তাঁর দাফন হবে। ঢাকা থেকে এসেছেন স্বামী রিজু মিয়া (দোকান কর্মচারী)। তাঁর কোলে দুই মেয়ে রীমা (৬) ও রিংকি (দেড় বছর)। তাদের কান্নার সঙ্গে কাঁদছে সবাই।
আরজিনার মা মোর্শেদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘গরিব মাইনসের সংসার। ঝড় আলো, বেটিটা পাশের ডোবায় মুখ ধোয়ার জন্য গেইল। দুখান খড়িও কুড়াছিল। কোঠে থ্যাকিয়া ডাল ভাঙ্গি পড়লো মাথাত। দ্যাখের এখনো ডোবার পাশে রক্ত লাগি আছে।’
মায়ের ছবি নিয়ে বারবার বাবাকে দেখাচ্ছিল রীমা, যে ছবিতে পুরো পরিবার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। দেড় বছরের রিংকি শুধুই মাকে খুঁজছিল। সকাল থেকে তাকে কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনি। বাবা রিজু বললেন, ‘কন তো, এখন এই বাচ্চাগুল্যাক কেটা সামলাবে? ’
একইভাবে বাদিয়াখালীর জোছনা রানীকে কাঁধে করে দাহ করতে নিয়ে গেছে তাঁর স্বজনরা। আহাজারি চলছে নিহতদের গ্রামগুলোতে।
সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব জাহাঙ্গীর কবীর তনু বলেন, এই ঝড় ১২ জনের প্রাণ কেড়ে নিল। শুধু একটু সাবধানতা এতগুলো জীবন রক্ষা করতে পারত। দুর্যোগে নিজেকে রক্ষা করার ব্যাপারে গ্রামীণ জনপদের মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া খুবই সহজ একটা ব্যাপার। অথচ দুর্যোগ প্রশমনের কথা শুধু শহরেই বলা হয়।
১২ জনের দাফন সম্পন্ন : গত রবিবারের ঝড়ে গাইবান্ধায় প্রাণ হারানো ১২ জনের দাফন গতকাল সম্পন্ন হয়েছে। মৃতরা হলেন সদর উপজেলার হরিণসিংহা গ্রামের হিরু মিয়ার ছেলে মুনির (৫), আরিফ খান বাসুদেবপুর গ্রামের আরজিনা বেগম (২৮), ঢনঢনিপাড়া গ্রামের সাহারা বেগম (৪১), মোল্লার চরের বাতাসী বেগম (৩০) ও রিফাইতপুর সরকারেরতারি গ্রামের জোছনা রানী (৫৫); গোবিন্দগঞ্জের রামপুরা গ্রামের শারমিন বেগম (২০); পলাশবাড়ী উপজেলার বাকেরপাড়া গ্রামের জাহানারা বেগম (৫০), মোস্তফাপুর গ্রামের আবদুল গোফ্ফার (৪২) ও কুমেদপুর গ্রামের স্ত্রী মমতা বেগম (৬৪); সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কিশামত হলদিয়া গ্রামের ময়না বেগম (৪৭); ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামারি গ্রামের শিমুলি বেগম (২৬) ও ডাকাতিয়ার চর গ্রামের হাফিজ উদ্দিন (৬৫)।
সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঝড়ে বিধ্বস্ত বাড়িঘর, পড়ে যাওয়া গাছপালা নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে বল্লমঝাড়, রামচন্দ্রপুর, কুপতলা, খোলাহাটি এলাকায় খোলা আকাশের নিচে রয়েছে শিশু-নারী-পুরুষ। খোলাহাটির মোহাম্মদ আলী (৫৫) জানান, ঘরবাড়ি জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সরকারি সাহায্য ছাড়া তাঁর পক্ষে কাজটি অসম্ভব। একই ধরনের কথা অন্য ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে।
এদিকে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, কালবৈশাখীতে জেলার সাত উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়নের ১৫ হাজার ৮৬০ জন এবং চার হাজার ৩২৬টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঝড়ে নিহত ১২ জনের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় ৮৬৯ হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ভুট্টা ৮৩০ হেক্টর, বোরো ২০ হেক্টর, কলা ১৬ হেক্টর ও সূর্যমুখী তিন হেক্টর। তবে এখনো ফসলের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি।
জেলা শিক্ষা অফিসার মো. এনায়েত হোসেন জানিয়েছেন, ঝড়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।