নিউজ ডেস্ক: কোনো কিছু বুঝে ওঠার মুহূর্তে আগুনে গ্রাস করে নিয়েছে নিজের ঘরসহ আরও অনেকের বাড়িঘর। সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। কোনো মতে সন্তানদের খুঁজে নিয়ে অনেক দূরে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে সবাই এক কাপড়ে আশ্রয় নিয়েছি। এই কয়দিন খোলা আকাশের নীচে রাত যাপন করতে হয়েছে। অনেকে খাবার দিয়েছে সে খাবার পরিবারের সবাই ভাগ করে খাই। আজ ক্যাম্পে নিজের (আগের) জায়গায় ঘর নির্মাণ করছি। দুঃখ যেন নিয়তির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের তিন সন্তানের জননী রাবেয়া বসরী (২৮)।
তিনি আরও বলেন, 'মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী সেখানে আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। সে সময় এদেশে পালিয়ে এসে কয়েক বছর শান্তিতে ছিলাম। কিন্তু আবার বিপদ। ক্যাম্পে আগুনে আমার সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে।' কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কান্নায় করতে লাগলেন তিনি। এক সময় কান্না থামিয়ে রাবেয়া আবারও বলতে শুরু করলেন, 'আমার খুব কষ্টের সংসার এই তিন ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি। আগে অনেকে আমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হইনি। অতীতের সব কথা ভুলে গিয়ে নতুনভাবে চলতে শুরু করলাম। আমার বড় ছেলে আবদুল আজিজ (১২) মেয়ে ফাতেমা খাতুন (১১) ছেলে মনজুর আলম (৯)।'
রাবেয়া বলেন, 'আমি কাঠ, বাঁশ ও পলিথিন তার, পেরেক পানি পেয়েছি। এনজিওর লোক এসে কিছু নগদ টাকা দিয়েছে। তাইতো সাহস করে তিন রোহিঙ্গা শ্রমিককে নিয়ে সকাল থেকে ঘর তৈরি করছি। হয়তো আগের মতো তেমন মজবুত হবে না। তারপরও কোনো মতে ঘর হলে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে।'
সরেজমিন উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে, ক্যাম্পের ভেতরে
টিন, বাঁশ, কাঠ ও পলিথিন দিয়ে ঘর নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। গাছপালা কেটে ও উঁচু জমি সমতল করে সেখানে শত শত ঘর নির্মাণ কাজ চলছে। কোনোটি টিনের, আবার কোনোটা পলিথিন, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করছে শ্রমিকরা। অগ্নিকান্ডের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে আবার নতুন করে বসতঘর তৈরি শুরু করেছেন রোহিঙ্গারা। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জরুরিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা জেলা প্রশাসনকে নগদ ১০ লাখ টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছে।
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৯ এর মাঝি জিয়াবুল হক বলেন, 'মিয়ানমারের আর্মিদের নিজ অত্যাচারে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া সে স্থানটিও আগুনে পুড়ে অঙ্গার।' তার বস্নকের ৮৩টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোথাও যাওয়ার তো জায়গা নেই, তাই সেই পোড়া মাটিতে আবারও নতুন করে ঘর তুলছেন। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সেবা সংস্থা বাঁশ, কাঠ ও ত্রিপল দিয়ে কোনোরকম বাসযোগ্য বসতি নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বেশকিছু সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খাবার, পানি, প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে।
বেসরকারি সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মী নুরুল আজিম, হারুনর রশিদ জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডে ঘটনায় বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হয়েছে। এখন সেই পুড়ে যাওয়া স্থানগুলো থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে রোহিঙ্গারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এই দুর্গন্ধ থেকে নানারকম রোগ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামসুদ দৌজা জানিয়েছেন, নতুন করে বসতঘর তৈরির কাজ শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ক্যাম্প ইনচার্জ) তদারকি করছেন। এছাড়া ক্যাম্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নতুন করে বসবাসের জন্য তাঁবু, বসতঘর তৈরির জন্য বাঁশ, নাইলন, রশি, ত্রিপল, পলিথিন, ঢেউটিন এসব সরবরাহ করছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সেবা সংস্থার নেতৃত্বে সুপেয় পানি, শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান পিপিএম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। - যায়যায়দিন