২১৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধাও দেওয়া যাবে না * কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানের ঋণেই জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ে সম্পৃক্ত থাকার অপরাধ উদঘাটিত
ডেস্ক রিপোর্ট :এননটেক্স গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংক থেকে নেওয়া ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিধিসম্মত না হওয়ায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিশেষ নীতিমালার আওতায় এ ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই গ্রুপের নামে ২১৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার সুদ মওকুফ সুবিধাও বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এননটেক্স গ্রুপ সরকারি খাতের ওই ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তা এখন সুদসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে এননটেক্স গ্রুপের যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লি., জ্যাকার্ড নিট টেক্স লি., সুপ্রভ কম্পোজিট নিট লি., এম নূর সোয়েটার লি., সিমরান কম্পোজিট লিমিটেড, সুপ্রভ স্পিনিং লি. ও শব মেহের স্পিনিং মিলস লি.।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা উদঘাটিত হয়।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা’ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত (রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেসব উদ্যোক্তা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না কেবল তাদের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া যাবে।
একই সঙ্গে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব গ্রাহক ঋণখেলাপি হয়েছেন তারা এ সুবিধা পাবেন। এর বাইরে অন্য কোনো কারণে খেলাপি হলে তিনি আর এই সুবিধা পাবেন না। অর্থাৎ জালজালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তিনি এই নীতিমালার আওতায় তা নবায়ন করতে পারবেন না। এর আওতায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এননটেক্স গ্রুপের উল্লিখিত ৭টি প্রতিষ্ঠানসহ ২২টি প্রতিষ্ঠানের ঋণের ক্ষেত্রে জালজালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ উদঘাটিত হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই সাত প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হওয়ার কারণে শ্রেণিকৃত হয়নি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সার্কুলারের আওতায় নবায়ন করার সুযোগ নেই।’
সূত্র জানায়, অথচ আলোচ্য নীতিমালার আওতায় এননটেক্সের ওই ঋণ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় নবায়ন করে। বিষয়টি অবগত হয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা থাকলে ওই ঋণের বিপরীতে সুদ মওকুফের সুযোগ নেই। অথচ এননটেক্সের আলোচ্য ৭টি কোম্পানির ২১৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। সুদ মওকুফের বিষয়টিও বাতিল করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই দুটি বিষয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদের মাধ্যমে বাতিল করে গ্রাহককে জানাতে হবে। একই সঙ্গে বিষয়টি জানাতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে তাদের ঋণ নবায়ন করার জন্য আলোচ্য সার্কুলারটি দেওয়া হয়েছে। এর আওতায় সব খেলাপি গ্রাহক ঋণ নবায়ন করতে পারে না। জালিয়াতি করে যারা ঋণ নিয়েছে তারা তো পারেই না।
তিনি আরও বলেন, জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং অপরাধ করে ঋণ নিলে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে এননটেক্সকে দেওয়া সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের পর্ষদ সভায় এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের হাল নাগাদ অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলে পর্ষদ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও মতামত প্রদান করে। এর মধ্যে ছিল ‘পর্ষদ লক্ষ করছে মঞ্জুরিকৃত এলসি লিমিটসমূহের আওতায় খোলা এলসি (নন-ফান্ডেড দায়) পর্যায়ক্রমে পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্টস) বা ডিমান্ড লোনে (ফান্ডেড দায়) পরিণত হচ্ছে। যা কোনোক্রমেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও স্বাভাবিক ব্যাংকিং লেনদেনের ইঙ্গিত বহন করে না।
সূত্র জানায়, এলসি, ব্যাংক গ্যারান্টি, রপ্তানি বিল, টাকা তোলার চেকসহ বিভিন্ন বাংকিং উপকরণ বন্ধক রেখে যেসব ঋণ নেওয়া হয় সেগুলো পরোক্ষ ঋণ বা নন-ফান্ডেড দায়। মেয়াদ পূর্তির আগে দায় শোধ হয়ে গেলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু শোধ না হলে ব্যাংক তা নিয়মিত ঋণে বা ফান্ডেড দায়ে পরিণত করে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকে মেয়াদি ঋণেও পরিণত করে। ফলে এগুলো আর আদায় হয় না। এননটেক্সেও অনেক ঋণের ক্ষেত্রে এসব ঘটেছে। যে কারণে তাদের খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ৮ মে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ফরেন এক্সচেঞ্জ অডিট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে এননটেক্স গ্রুপের ৪টি প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লি., জ্যাকার্ড নিট টেক্স লি., সুপ্রভ কম্পোজিট নিট লি. ও সিমরান কম্পোজিট লিমিটেডের মাধ্যমে এলসি খোলা ও পিএডি দায় সৃষ্টির বিষয়ে উদঘাটিত অনিয়মগুলো তুলে ধরা হয়। ওই বৈঠকে এননটেক্সের ৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে পিএডি/ডিমান্ড লোন সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়মের তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর পর্ষদ সভায় এননটেক্স গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিল করার মঞ্জুরিপত্রে শর্ত দেওয়া হয় যে, ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা সার্কুলার সব শর্ত পালন করলেই ঋণ নবায়ন কার্যকর হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে যদি উদঘাটিত হয় যে, নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট কোনো ঋণ খেলাপি হয়েছে তা হলে এ সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত ২৮ জানুয়ারি যে চিঠি ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, এননটেক্স গ্রুপের উল্লেখিত ৭টি প্রতিষ্ঠানসহ ২২টি প্রতিষ্ঠানের ঋণের ক্ষেত্রে জালজালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ উদঘাটিত হয়েছে। ফলে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে শ্রেণিকৃত হয়নি।
সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে এননটেক্স গ্রুপের নামে ঋণের পরিমাণ ছিল খুবই কম। ২০১২ সালের পর থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ওই বছরে গ্রুপের ঋণ ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে বেড়ে হয় ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে আরও বেড়ে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। পরোক্ষ ঋণ বা নন-ফান্ডেড লোন পরিশোধ না করায় সেগুলো প্রত্যক্ষ ঋণ বা ফান্ডেড দায়ে পরিণত হয়।
এতে ২০১৬ সালে ঋণের পরিমাণ বেড়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যা আরও বেড়ে প্রত্যক্ষ বা নগদ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ ঋণ ৬ হাজার ২৪০ কোটি ১৭ লাখ এবং পরোক্ষ ঋণ ৬২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। - যুগান্তর