ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: বাঙালির ঐতিহাসিক ‘মুক্তির সংগ্রাম’-এর প্রকৃত অর্জন বা বিজয় বিবেচনার জন্য বিগত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের প্রত্যয় ও প্রতীতির স্বরূপ পর্যালোচনার প্রসঙ্গটি বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের প্রাক্কালে এসেই যায়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধ করণে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে সমাজে কিংবা সংসারে এমনকি যেকোনো কায়কারবারে সকলের সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, উদ্দেশ্য অর্জন তথা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোয় ঐকান্তিক প্রয়াসে সমর্পিতচিত্ত ও স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন জরুরি, তেমনি জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতাও একইভাবে অনস্বীকার্য। জাতীয়... ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। অপচয় অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সকলের মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলদ্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে উঠে যে নিষ্ঠা ও আকাক্সক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। দায় দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবীদার হওয়া বাতুলতা মাত্র।
প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সব প্রয়াস প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়কে অয়োময় প্রত্যয় প্রদান সমাজ উন্নয়নের পূর্বশত। একজন কর্মচারীর পারিতোষিক তার সম্পাদিত কাজের পরিমান বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি বেতন পেতে পারে, তাহলে দক্ষতা অর্জন এর প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবেই। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলেই যেকোনো ঊৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্রপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মন্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভু হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠিকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায় উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায় দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনিহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণিনির্বিশেষে সকলের কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছতা সাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কীভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর পরিচয়ে যে অঢেল অর্থব্যয় চলে তা যেন এমন এক বিনিয়োগ যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগ আছে বলেই।শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিত চিত্ত হওয়ার বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদন বিমুখ আর শ্রমিক স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষনের প্রতিভু বনে যায় তখন দেখা যায় যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচণ্ড স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন তথা শ্রমিক উন্নয়ন সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
যেকোনো অজুহাতে অপচয় অপব্যয় তহবিল তছরূপ আত্মসাত যেকোনো সবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারাকেও করে দ্বিধান্বিত। বাধাগ্রস্ত। এসব রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। প্রত্যেক নাগরিকেরই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য স¤পর্কে সজাগ হওয়ার মধ্যেই সুখী ও সমৃদ্ধশালী সমাজ ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ নিহিত। আগেই বলা হয়েছে মানুষই তার পরিবেশের ...। তাকে সজ্ঞান সচেতনতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনের। সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে তার নিজের অংশগ্রহণকে অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার দরকার। সংসারে নানান বাদ প্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায় দায়িত্ব তদানুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্র্দিষ্ট নিয়মে।
বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার সংস্কার ও কিংবা উন্নয়নকামী যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবায়ন যোগ্যতার এবং বাস্তবায়নের দৃঢ়চিত্ততার বিষয় বিবেচনা অগ্রগণ্য না হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তরিক প্রয়াস নিশ্চিত হয় না। জাতীয় ঊন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টি রূপকল্প প্রণয়নকারীর, প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সকল সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। সমস্যারা পর¯পরের মিত্র একটার সাথে একটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সাথে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সাথে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সাথে আয় উপার্জনের সকল কার্যক্রমের কার্যকরন গত স¤পর্ক রয়েছে। দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয় উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে, কর্মদক্ষতা ও কর্ম ক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটাকে উপেক্ষা মানে যুগপৎভাবে অন্যান্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেওয়া। সমস্যার উৎসে যেয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, এ কাজ সকলের। সমস্যার মোকাবেলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টিতে, আস্থা আনয়নে ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাস্দ্ধিবাদী বশংবদ বেনিয়া মুৎসুদ্ধি মানসিকতার সাথে আপোষ করার সুযোগ থাকতে নেই। অতীতে এই ভূখন্ডে যতোগুলো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্কার কর্মসূচি কিংবা ধ্যানধারণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাদের কম বেশি ব্যর্থতার পেছনে বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে অপারগতাই মুখ্য কারণ ছিল। বাংলাদেশের বিজয় দিবসের উনপঞ্চাশতম বার্ষিকীতে দেশ ও সমাজ উন্নয়ন ভাবনা অর্থনৈতিক মুক্তি অভিসারীকরণের তাগিদে, অনুভূতিতে সর্বত্র যথা বিবেচনার আলোকে আলোকিত হোক এই প্রত্যাশা ।
লেখক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।
আপনার মতামত লিখুন :