বিপ্লব পাল : সেটা ১৯৯৯। আমি তখন উত্তর ইতালির শহর তুরিনে। পলিটেকনিক ডি ট্যুরিনোর হোস্টেলে থাকতাম। যে হোস্টেলে অধিকাংশ বাসিন্দা দক্ষিণ ইতালি থেকে। বারি, নেপলস ইত্যাদি। ম্যারাডোনা তখন ইতালিতেও অতীত। ১৯৯১ সালে মাদকাসক্তির জন্য নেপোলি তাকে রিলিজ করতে বাধ্য হয়।
উত্তর ইটালির সাথে দক্ষিণ ইটালির বনিবনা কম। উত্তর ইটালি শিল্পোন্নত। সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, সেরা ক্লাবগুলো সেখানে। ইতালিয়ান লিগে জুভেন্তাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলান, এসি রোমার প্রাধান্য। এগুলো উত্তর ইটালির। নেপলস দক্ষিন ইতালির একটি শহর। সেখানে বেকারত্ব বেশি, শিল্প নেই, মাফিয়াদের রাজত্ব। এ হেন শহরের ক্লাব নেপোলি। লীগে বরাবর নীচের দিকে থাকত।
আমি যে হোস্টেলে থাকতাম, সেখানে নেপলস থেকে অনেক ছেলেরা ছিল। ম্যারাডোনা এক দশকের অতীত তখন। কিন্তু কী আশ্চর্য কী ডিনারে, কী স্টেডিয়াম ডেল আল্পিতে (আল্পস স্টেডিটাম) জুভেন্তাসের খেলা দেখতে গেলেও ম্যারাডোনার নাম উঠত। নেপলস তাকে ভুলতে পারেনি। ইতালিয়ান লিগে তখন ২৭টা টিম।
নেপোলি প্রথম কুড়ির মধ্যে থাকে না। কিন্তু ব্যাতিক্রম ১৯৮৫-৯০। যখন ম্যারাডোনা নেপোলিতে খেলেছেন। তখন নেপোলি প্রথম বা দ্বিতীয় ছিল লীগে। নেপলসে মারাদোনা ছিল ভগবান। যিনি নেপলবাসিদের তাদের দারিদ্র, পিছিয়ে পড়ার গঞ্জনা সব ভুলিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ওই কয়েকটা বছর গোটা শহরের জীবন ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনায় আচ্ছন্ন। এতোটাই যে এক দশক বাদেও সেখানকার ছেলেমেয়েরা ফুটবলের প্রসঙ্গ উঠলেই , ম্যারাডোনা দ্য লেজেন্ডের প্রসঙ্গ উঠতে সময় লাগত এক মিনিট।
ম্যারাডোনার নাম প্রথম পেপারে শুনি ১৯৮৪ সালে। বার্সিলোনায় অনেক ‘কাহানির’ জন্য তাকে বেচে দিতে বাধ্য হলো নেপোলিতে। ট্রান্সফার ফি রেকর্ড। ৭ মিলিয়ান ডলার। কিন্তু ম্যারাডোনা কি চিজ সেটা বুঝতে সময় লেগেছে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত। কারণ তার আগে টিভি সহজলভ্য হয়নি। ১৯৮৬ একটা ল্যান্ডমার্ক ইয়ার অধিকাংশ বাঙালির জীবনে। এর আগে টিভিতে ফুটবল বলতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা দুএকবার দেখেছি। ১৯৮৬ সালের বিশ^কাপ সব বদলে দিল। পাশ, ড্রিবলের ডেফিনিশন আন্তর্জাতিক ফুটবলে আলাদা সেটা আমরা বুঝলাম। বাঙালি সেই বছর আন্তর্জাতিক হলো। আর এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেল আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের কোয়াটার ফাইনাল।
আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে জিতল। দুই গোলই ম্যারাডোনার। একটা গোল শতাব্দি বা সর্বকালের সেরা। মাঝমাঠ থেকে চারজনকে কাটিয়ে। অন্যটা মারাদোনার ভাষায় হ্যান্ড অব গড- না হেডে তিনি গোল করেননি, হাত দিয়েই গোলটা দিয়েছিলেন। রেফারি ধরতে পারেননি। কিন্তু ভাগ্যত বীরেরই সহায় হয়!
ওই ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা ম্যাচটার গুরুত্ব ছিল ফাইনালের থেকেও বেশি। কারণ এর আগে ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা- ইংল্যান্ড ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ফকল্যান্ড আর্জেন্টিনার কাছে একটি দ্বীপ। যেখানে মূলত ব্রিটিশ সেটলারা থাকতেন। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দ্বীপটির আর্জেন্টিনার। ১৯৬৫ সালেই ব্রিটেন দ্বীপটি আর্জেন্টিনাকে ফেরত দিতে চাইছিল। কিন্তু সেই দ্বীপের অধিবাসীরা রাজি হয়নি। এর মধ্যে আর্জেন্টিনাতে ক্ষমতায় আসে সামরিক জুন্টা। আর্জেন্টিনার অর্থনীতি মুখ থুবরে পড়ে।
জনগণের বিক্ষোভ ভোলাতে সামরিক শাসক লিওপোল্ডো গ্যাটলীয়েরি ফকল্যান্ডে সামরিক অভিযান চালিয়ে দ্বীপটি দখল করেন। ব্রিটেনের প্রত্যুত্তরে সেনা পাঠায় এবং জুন মাসে আর্জেন্টিনার সেনা বাহিনী ব্রিটেনের কাছে আত্মসমর্পন করে। ফলে কোয়াটার ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচে পারদ চড়তে থাকে। ম্যারাডোনাও উত্তেজক জাতিয়তাবাদী কথাবার্তা বলে তাতাতে থাকেন। তারপর ওই হাত দিয়ে গোলটা ফকল্যান্ড দ্বীপের থেকেও ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত ।
মুশকিল হচ্ছে ‘বামপন্থী’ ম্যারাডোনা সেই সময় তার দেশের ফ্যাসিস্ট মিলিটারি শাসনের হাতই অলক্ষ্যে শক্ত করছিলেন। নেপোলিতে খেলার সময় ম্যারাডোনা দক্ষিণ ইতালির মাফিয়াদের সংস্পর্শে আসেন। মাদক নেওয়া শুরু এই সময়। তার পারফর্মান্সের গ্রাফ পড়তে থাকে। বিপ্লবী ডায়ালগ বাড়তে থাকে। নেপোলি থেকে বিতাড়িত হন। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে মাদক সেবনের জন্য ১৮ মাস নির্বাসিত।
ফলে সিস্টেমের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ বা বামপন্থা বাড়তে থাকে। বাংলার বামছাগলরা এতে বেশ উদ্বেলিত যে ম্যারাডোনা সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। কিন্তু তাদের কেউ ভেবে দেখে না। পুরোটাই ম্যারাডোনার সাজানো নাটক-ফ্যানবেস চাঙা রাখতে। কারণ ম্যারাডোনা চিরকাল বিলাস বহুল জীবনেই অভ্যস্থ ছিলেন। চে গুয়েভেরার উল্কি করে ৩৪০ মিলিয়ানের ইয়াটে বান্ধবী নিয়ে মাদক সেবন আর যাইহোক বামপন্থার উজ্জ্বল উদাহরণ না! তবে আমরা যারা তার খেলার ভক্ত-বামপন্থাটা নেহাতই ম্যারাডোনার জীবনের ফুটনোট। তার ম্যাজিক্টাই আসল।
অবশ্য গোটা পৃথিবীর বামেরা এতো কিছু গভীরে ভাবে না। গভীরে ভাবলে তারা বামপন্থায় আকৃষ্ট হতো না। বন্ধও ডাকতো না। ম্যারাডোনার স্বঘোষিত বামপন্থায় উদ্বেলিতও হ না। তার পায়ের জাদুই শেষ কথা হত সবার জীবনে।