ডেস্ক রিপোর্ট : ঘটনা-১:হৃদয় হোসেন আদালত চত্বরে ছোট ব্যবসা পরিচালনা করত। বাসা শহরের মজমপুরে। পূর্ববিরোধের জেরে গত ১২ নভেম্বর প্রতিপক্ষের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দিনে-দুপুরে তাকে ছুরিকাঘাত করে। বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সে। অবস্থা এখনও গুরুতর।
ঘটনা-২:কয়েক মাস আগে শহরের কুঠিপাড়ায় ফুটবলা খেলায় কথা কাটাকাটি নিয়ে কিশোর তারিকুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করে আরেক দল কিশোর। ওই ঘটনায় নিহত তরিকুলের পরিবার থেকে ছয়জনকে আসামি করে থানায় মামলা করা হয়। পরে পুলিশ তদন্তের পর একজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়। তারিকুলকে হারিয়ে তার মা পাগলপ্রায়।
ঘটনা-৩:গত ১৯ নভেম্বর শহরের হাউজিংয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী লাবিব আসলামকে তার কয়েকজন সহপাঠী ডেকে নিয়ে মারধর করে। এই মারধরের ভিডিও তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
ওপরের তিনটি ঘটনাই করোনা মহামরির সময়ে ঘটেছে। এর বাইরেও কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি মারামারির ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এসেছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ কিশোর গ্যাং ও তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ প্রতিটি ওয়ার্ডের কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা প্রস্তুত করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কিশোর গ্যাংকে পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ছাত্রলীগের বিতর্কিত কয়েকজন নেতা। তারা নানা অপকর্ম করে দল থেকে বহিস্কারের পাশাপাশি জেলও খেটেছেন। এসব নেতা মাদক কারবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের তারা দলে ভেড়ান। তাদের নেতৃত্বে জেলায় ২০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। যার অর্ধেকের বেশি শহরের কয়েকটি ওয়ার্ড ঘিরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদের নেতৃত্বে আছেন থানাপাড়া এলাকার নিবিড়, টুটুল ও কালিশংকরপুরের এসকে সজিব। এ ছাড়া কোর্টপাড়া এলাকায় আজমল গনির রয়েছে আলাদা দল। আজমল জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। অপকর্ম করে দল থেকে বহিস্কার হন। এসকে সজিবও জেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলেন। আর নিবিড় কুঠিপাড়া এলাকার সন্টুর ছেলে। ছোট বেলা থেকেই সে বেপরোয়া। তার টিমে ২০ জনের মতো কিশোর রয়েছে। নানা অপকর্ম করে টুটুলও জেল খেটেছে। মাদক কারবারের মতো অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের সবচেয়ে বড় নেতা আলফামোড় এলাকার আব্দুল জলিলের ছেলে জীবন আহমেদ অমি। আব্দুল জলিল বিএনপির বড় একজন পৃষ্ঠপোষক ও অর্থদাতা। তার বড় ছেলে রনি জেলা ছাত্রদলের শীর্ষ নেতা ছিলেন। সম্প্রতি মামলায় পড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। রনির ছোট ভাই অমি কুষ্টিয়ায় একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টেও তার নাম এসেছে। সপ্তাহখানেক আগে হৃদয়কে ছুরিকাঘাতে নেতৃত্ব দেয় অমি, সজিব ও নিবিড়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অমি নিজেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সে ঢাকার একটি কলেজে পড়াশোনা করে। কুষ্টিয়ায় এলে দলবল নিয়ে চলাফেরা করে। মন্ত্রীর পরিচয়ে জেলায় তার টিমের সদস্যরা নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। পুলিশও বিষয়টি জানতে পেরেছে।
শহরে অমির ৫টি 'হ্যান্ড' রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আড়ূয়াপাড়ার মিলন শেখের ছেলে এসকে সজিব, থানাপাড়ার সন্টুর ছেলে নিবিড়, শাজাহান আলীর ছেলে বিপ্লব ওরফে বিল্লু, হাউজিং এলাকার মীর শওকত আলীর ছেলে মীর আহসানুল হক অভিসহ কয়েকজন। এর বাইরেও শহরের দুই কাউন্সিলের ছেলেরও রয়েছে কিশোর গ্যাং। তারা মোটরসাইকেল বাহিনী হিসেবে পরিচিত।
গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শহরে ১১টির কিশোর গ্যাং রয়েছে। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। গত তিন বছরে জেলা ছাত্রলীগের ৫ জন নেতাকে নানা অপকর্মের জন্য সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়, যাদের প্রায় সবাই কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। এ ছাড়া পুলিশের তথ্য মতে 'বেড বয়েজ', '০০৭', 'বিএসবি গ্রুপ'সহ বড় চারটি গ্রুপ রয়েছে, যাদের সদস্য সংখ্যা অর্ধশত। কয়েক বছর আগে উপজেলা রোডে তুচ্ছ ঘটনায় দুই ব্যক্তিকে হত্যা করে কিশোররা। তখন থেকেই কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি সামনে আসে।
এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে মনে করেন কুষ্টিয়া আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী। তিনি বলেন, অপরাধ অপরাধই। শিশু, করুক বা বয়স্ক কেউ করুক- অপরাধীদের ছাড় দিলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তাই তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজের ভূমিকা রয়েছে কিশোরদের বিপথ থেকে ফেরানোর।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, বেশ কিছু ঘটনায় কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। শহরে যাতে কিশোররা কোনো অপরাধ করতে না পারে সে জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। অপরাধী যেই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে সবাইকে সহনশীল হতে হবে। শিশু-কিশোরদের প্রতি অভিভাবকদের দায়িত্ব বেশি। তাই পরিবারকে থেকেই পরিবর্তন আসতে হবে। সমকাল