ডেস্ক রিপোর্ট: ঢাকা মহানগরীতে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা তারের জঞ্জাল অপসারণের সিদ্ধান্ত এক দশকেও বাস্তবায়ন হয়নি; কোথাও একবার তার সরানো হলেও কয়েক ঘণ্টা পর আবার সেখানে তার টানা হচ্ছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
পরিষেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল অপসারণ নিয়ে ১০ বছর ধরে চলছে এক ইঁদুর-বিড়াল খেলা।
নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের (এনটিটিএন) আওতাধীন অপারেটরদের ভূগর্ভস্থ লাইন দিয়ে ইন্টারনেট ও কেবল টিভির সেবা দেওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, টেলিফোন লাইন ও ডিশ লাইনের তার বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধেই বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ঢাকার প্রায় সব রাস্তার পাশেই মাথার ওপর এখন তারের জঞ্জাল। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা এসব তার ছিঁড়ে মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে; কখনও কখনও অগ্নিকাণ্ডেরও কারণ ঘটায়। উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সঙ্গে ইন্টারনেট, টেলিফোন ও কেবল টিভির এসব তার অপসারণে আদালতের নির্দেশ থাকলেও মানছে না কোনো সেবা সংস্থা।
গত ৫ অগাস্ট থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তারের জঞ্জাল অপসারণ করা হচ্ছে। তবে অভিযানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের ১০ কোটি বেশি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তাদের সংগঠন আইএসপিএবির দাবি।
তার কাটার পর সংযোগ দিতে নতুন করে আবার তার টানছেন তারা। ফলে কয়েক ঘণ্টার ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা।
আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম গণমাধ্যমকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এনটিটিএনের কাছ থেকে সংযোগ বা তার ভাড়া নিয়েই তাদের ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। তবে তাদের লোকাল ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট (এলডিপি) গ্রাহক অবস্থানের খুব কাছাকাছি নেওয়া যায়নি বলে ‘বাধ্য হয়েই’ তার টেনে সংযোগ দিতে হয়।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “গুললান ১ থেকে গুলশান ২ নম্বর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিশন সেবাদাতা ফাইবার অ্যাট হোমের মাত্রা চারটি টার্মিনেশন পয়েন্ট (লোকাল ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট (এলডিপি) রয়েছে। তাই সংযোগ দিতে বাধ্য হয়ে আমাদের তার টানতে হয়। প্রতি দুই বা তিনটি বাড়ি অন্তর অন্তর এ পয়েন্ট থাকলে আর তার টানতে হত না।”
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, ঢাকায় প্রায় ৪৫ লাখ ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি গ্রাহক দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায়। একবার অপসারণ করলে বাধ্য হয়েই গ্রাহকের স্বার্থে আবার তার টানা হচ্ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া রাজধানীকে ঝুলন্ত তার থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।
কেবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, এনটিটিএনগুলো (নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) এখনও অবকাঠামো তৈরি করতে পারেনি বলে বাধ্য হয়ে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে তাদের তার লাগাতে হয়।
“ঢাকা দক্ষিণে কেবল অপসারণে আমাদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আবারও সেখানেই তার লাগাতে হচ্ছে।”
তবে সুবিধা তৈরি না হওয়ার যে অভিযোগ ব্রডব্যান্ড সেবাদাতা ও কেবল অপারেটররা করছে, তা ‘সঠিক নয়’ দাবি করে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারাই সেবা নিতে ‘আগ্রহী নয়’।
ফাইবার অ্যাট হোমের হেড অব পাকলিক রিলেশন অ্যান্ড গভমেন্ট অ্যাফেয়ার্স অফিসার আব্বাস ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, “আইএসপিগুলো যে অভিযোগ করছে তা ঠিক নয়। কারণ গুলশানসহ বনানী, মহাখালী ডিওএইচএস, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, নিকেতনে (এফটিটিএইচ) বাড়ি পর্যন্ত সংযোগ নেওয়া হয়েছে।
“এছাড়া রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো সংলগ্ন প্রচুর পরিমাণ পয়েন্ট রয়েছে, এতে বাড়তি তার টানার প্রয়োজন নেই। শুরু থেকে তারা যদি এনটিটিএন সেবা নিত তাহলে এ সমস্যা হত না।”
একই কথা বললেন এনটিটিএন কোম্পানি সামিট কমিউনিকেশনসের প্রধান নির্বাহী আরিফ আল ইসলামও।
“ঢাকা শহরে মূল রাস্তার পাশে যথেষ্ট সংখ্যক এলডিপি রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে অনেকেই এ সেবা নিচ্ছে না। এনটিটিএন লাইসেন্সের শর্তে বাড়ি পর্যন্ত সংযোগ নেওয়ার কথা নেই, তাও আমরা বাড়ি পর্যন্ত সংযোগ নিয়ে যাচ্ছি। তবে আইএসপিগুলো সেই সেবা নিচ্ছে না।”
তবে ‘হঠাৎ অভিযানে’ এ সমস্যার সমাধান হবে না মন্তব্য করে আরিফ বলেন, “তারের জঞ্জাল অপসারণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত, তাহলে একটি সমাধান আসতে পারে।”
ঝুলন্ত তার অপসারণে অনড় অবস্থানের কথা বারবার বলে আসছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস। এর মধ্যে বঙ্গবাজার ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে নগর ভবন হয়ে গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়া মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও বৃহস্পতিবার থেকে একই ধরনের অভিযান শুরু করেছে। তবে গ্রাহকদের ভোগান্তি এড়িয়ে সমন্বিত পদক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আমি বলিনি হুটহাট করে তার সরিয়ে দিতে। এত জনগণ দুর্ভোগে পড়বে। এজন্য আমি সবাইকে ডেকেছি সবার সঙ্গে কথা বলেছি। প্রক্রিয়াটি আমি সাসটেইনেবল করতে চাই। আমি সবার সঙ্গে কথা বলেছি।
“ডিএনসিসির যেসব রাস্তার পাশে ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ হচ্ছে সেখানে ফুটপাতের নিচে ডাক্টিং পাইপ ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এই পাইপের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন কেবল অপারেটররা তার নিয়ে যাবে। এজন্য আমাদের মাসিক বা বাৎসরিক একটা টাকা দিতে হবে। যেসব এলাকায় ডাক্টিং দেওয়া যাবে না, সেখানে বিকল্প কী করা যায় তাও আমরা চিন্তা করছি। কিন্তু তার নামাতেই হবে।”
আগামী এক বছরের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার সড়কের ঝুলন্ত তার নামিয়ে ফেলা হবে বলে বৃহস্পতিবারই ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র আতিক।
দক্ষিণের সমস্যা সমাধানে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে, তার টেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে প্রতি আইএসপির ২৫ লাখ টাকা করে বার্ষিক ফি দিতে হবে, যা আইএসপিগুলোর পক্ষে সম্ভব না।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব না হলেও জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের লিখিত উত্তর পাঠিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছ হতে যথাযথ আবেদন প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে অনুমোদন নিয়েই আইএসপিগুলোকে কেবল সংযোগ দিতে হবে। কিছু শর্তে তাদের সেই অনুমোদন দেওয়া হবে।
“আমাদের লক্ষ্য হল এই ঢাকা শহরকে একটি উন্নত শহর হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের প্রাণের এই ঢাকা শহর আকাশ-পানে তারের জঞ্জাল ছেয়ে গেছে। তাই এই শহরকে তারের জঞ্জালমুক্ত করার লক্ষ্যে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে প্রতিদিনই অবৈধ কেবল অপসারণ করছি। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা তারের জঞ্জালবিহীন একটি শহর ঢাকাবাসীকে উপহার দিতে চাই।”
মহামারীর মধ্যে শিক্ষার্থী থেকে চাকরিজীবী অনেকেরই যেখানে ইন্টারনেট নির্ভরতা বেড়েছে, সেখানে তার সরাতে গিয়ে দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে অভিযোগ করছেন অনেকে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে দক্ষিণের মেয়র বলেন, তারের জঞ্জাল সরানোতে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন পড়াশোনা বিঘ্ন ঘটছে- বিষয়টি তেমন নয়।
“বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ডেটা প্যাক এখন খুবই সস্তা। ৫০০ টাকায় ৩০ জিবির বেশি ডেটা এখন কিনতে পাওয়া যায়।”
অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত ঝুলন্ত তার অপসারণ করে আসার পর কয়েক ঘণ্টা না যেতেই আবার সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে মেয়র তাপস বলেন, “আমি শুধু বলব, আমরা এখনো অবৈধ কেবল অপসারণ করছি মাত্র,তাদেরকে জেল জরিমানা করছি না। কিন্তু তারা যদি অপসারণের পর আবার এসব অবৈধ সংযোগ পুনঃস্থাপন করেন, তবে অবশ্যই আমরা আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইনের ২৫ ধারায় বলা আছে, সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার স্থানীয় কার্যালয়ের লিখিত অনুমোদন ছাড়া কোনো স্থাপনা কেবল সংযোগের কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
আইনের ২৮ (২) উপ-ধারা অনুযায়ী, এ নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে। অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে।
মেয়র তাপস বলেন, “আমরা কঠোর মনোভাব দেখাতে চাই না। কিন্তু তারা যদি আমাদেরকে বাধ্য করতে থাকেন, তবে আমাদের আরও কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না।”
তারের জঞ্জাল থেকে রাজধানীকে মুক্ত করতে ২০০৯ সালে সব তার সরিয়ে মাটির নিচে নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ঝুলন্ত তার অপসারণে ২০১০ সালে একবার উদ্যোগও নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। সে সময় সব পক্ষকে নিয়ে সচিবালয়ে বৈঠক হলেও কোনো ফল আসেনি।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ সচিব সুলতান আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে ঝুলন্ত তার অপসারণে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। মহামারী শুরু হওয়ার পর সে কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
ঢাকা শহরে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ঝুলে থাকা সব সেবা সংস্থার অবৈধ তার কেটে দিয়ে তা অপসারণের কাজ গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।
ঢাকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে প্রচলিত খুঁটি অপসারণে চীনের অর্থায়নে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। পর্যায়ক্রমে ঢাকার আরেক বিদ্যুৎ বিপণন সংস্থা ডেসকোও একই ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে বলে জানানো হয়েছিল।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, “কিছু কিছু এলাকায় আমাদের লোকজন ঝুলন্ত তার সরিয়ে দিয়েছে। যেসব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এই তারগুলো বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের বার বার বৈঠক হচ্ছে কীভাবে এই তারগুলো মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া যায়। সম্প্রতি মহামারী পরিস্থিতির কারণে কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে অচিরেই এ নিয়ে আরেকটি মিটিং বসবে।
“জাহাঙ্গীর গেইট থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত প্রধান সড়কে থাকা ডিপিডিসির তারগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে আইএসপি, স্যাটেলাইন কেবল সেবাসহ অন্যান্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান আমরা জানিয়েছে।
আরেক বিতরণ সংস্থা ডেসকোর প্রকৌশলী মফিজ উদ্দিন বলেন, “চলতি বছরের শুরুর দিকে ঢাকায় পাঁচটি স্থানকে নির্ধারণ করা হয়েছিল অবৈধ ঝুলন্ত তার অবসারণের জন্য। ডেসকো এলাকায় পড়েছে মহাখালী ডিওএইচএস আর নিকেতন। এসব এলাকার তার অপসারণ করা হয়েছিল।
“এখন কী পরিস্থিতি বলা যাচ্ছে না। কারণ মহামারীর সময়ে বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট সেবা দিতে গিয়ে অনেকেই সেই তার আবার স্থাপন করেছেন।“