শিরোনাম
◈ শ্রীলঙ্কার কা‌ছে আফগা‌নিস্তান হে‌রে যাওয়ায় সুপার ফো‌রে খেলার সু‌যোগ পে‌লো বাংলাদেশ ◈ বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে টিউলিপের মিথ্যাচার, নতুন সংকটে স্টারমার: ডেইলি এক্সপ্রেসের রিপোর্ট ◈ শুধু অতীতের নয়, বর্তমানের দুর্নীতি থামাতেও নজর দিতে হবে: বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ◈ বাংলাদেশ ও চীন সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে একসাথে এগিয়ে যাবে : প্রধান উপদেষ্টা  ◈ সাফ চ‌্যা‌ম্পিয়নশী‌পে নেপালকে ৪-০ গো‌লে হারা‌লো বাংলাদেশ ◈ শ্রীলঙ্কার প্রতি বাংলা‌দে‌শের সমর্থন, চোখ এড়ায়নি লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের ◈ আফগানিস্তান-শ্রীলংকা ম্যাচের ফল যেমন হলে লাভ বাংলাদেশের ◈ নির্বাচনী দায়িত্বে অপরাধের সাজা বাড়ছে: অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন ◈ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত সম্পূর্ণভাবে পৃথক করলো সরকার ◈ কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয় বিএনপি : সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:১৫ দুপুর
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:১৫ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা : সংসদে বিরোধী দল বিষয়টি কি তবে উঠেই গেল?

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা : সংসদে বিএনপি করে সরকারের সমালোচনা আর মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখে উত্তর দিচ্ছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির অতি উৎসাহে এমনকি হতাশ আর বিস্মিত চোখে তাকাতে দেখেছি সরকারদলীয় সাংসদদেরও। কারণ ভানের বিরোধী দল হলেও একটা বিরোধী দলের অভিনয় যে দক্ষতায় করা প্রয়োজন, সেই দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় পার্টি। কিন্তু সেই অভিনয় যে কতোটা জরুরি সেটা আর কেউ না বুঝলেও সরকারি দল ভালো মতোই অনুধাবন করে, আর তাই তাদের এই বিস্ময়। শুনতে পাই আড়ালে-আবডালে নাকি তারা জাতীয় পার্টির সদস্যদের মনেও করিয়ে দেন যে, তারা কিন্তু আসলে এখন “বিরোধী দল”।

১৯৯১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোটামুটি একটি কার্যকর সংসদের স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ যেখানে অন্ততপক্ষে বিরোধী দল বলে একটা বস্তুর অস্তিত্ব ছিল। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার পরে আওয়ামী সরকার পড়ে মহাবিপদে।

বিএনপিকে নির্বাচনে এনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে হলে তাদের যে পথে হাঁটতে হতো তাতে তাদের নিজেদের হিসাবেই সম্ভবত তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। আর সে কারণেই বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচনের আগেই ১৫৩টি আসনে নির্বাচন ছাড়া জয়ী হয়ে, অর্থাৎ নির্বাচনের আগেই সরকার গঠন নিশ্চিত করে।

বিশ্ব দরবারে এক নজিরবিহীন নির্বাচন উপহার দেয় আওয়ামী লীগ। এতে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়ে জাতীয় পার্টি। তারা প্রথমে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ত্রি-বিধ চক্রের শিকার হয়ে নির্বাচনে কেবল যে অংশ নিয়েছে তাই নয়, বরং অদ্ভুতভাবে তারা সরকার এবং বিরোধী দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। এমনকি তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদ, যিনি কিনা এককালে রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ নিয়ে নিলেন। পাতানো খেলায় কতো কী যে হয়! একজনকে কেবল তুষ্ট করলে চলবে না। মুখ তো অনেক। সুতরাং মন্ত্রিত্ব নামক অন্ন তুলে দেয়া হয় আরো তিনজনের মুখে।

২০১৪ থেকে ২০১৮ জাতি বেকুব বনে রইলো। কে সরকারি আর কে বিরোধী সেটা না জানে তারা নিজেরা, না জানে দেশের মানুষ। রিক্ত, নিঃস্ব, অসহায় সর্বস্ব হারানো জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার কিছু বক্তব্যে তাদের তখনকার অবস্থা কিছুটা বোঝা যায়। দশম সংসদে তিনি বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আপনার মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের বাদ দিন। আপনি চাইলেই এটা হয়। কেনো চান না? বুঝি না। আপনি আমার দলের মন্ত্রীদের বাদ দিলে জাতীয় পার্টি বেঁচে যেতো। তা না হলে আপনি আমাদের দলের সবাইকে মন্ত্রী বানান।’ তিনি বলেন, ‘কোথাও গেলে কথা বলতে পারি না। লজ্জা লাগে। সাংবাদিকদের সঙ্গেও লজ্জায় কথা বলি না। তাদের এড়িয়ে চলি। তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। আমরা সরকারি দল, না বিরোধী দল পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারি না। আপনি বিদেশে যান, সেখানে গিয়ে কি বলতে পারেন যে দেশে বিরোধী দল আছে? আমি তো দেশে-বিদেশে কোথাও জোর গলায় বলতে পারি না যে, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছিলাম মন্ত্রিসভা থেকে আমাদের পার্টির সদস্যদের বাদ দিন। কিন্তু সেটা হয়নি। এ ভাবে টানাটানি করে বিরোধী দল হওয়া যায় না।’ রওশন এরশাদ বলেন, ‘আরো এক বছর আছে, দেখেন সেটা। আপনি নির্দেশ দিলে মানবে না কে? আপনি তো দিলেন না?’ এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে
বলতে শোনা যায়, ‘আমি তো বলেছিলাম।’ জবাবে তিনি বলেন, ‘না দেন নাই, দেন নাই, না- না- না।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে রওশন প্রশ্ন করেন, ‘আপনি বলতে পারেন বিরোধী দল আছে? আমরাও বলতে পারি না।’ সার্কাসটা হলো বিরোধীদলের নেত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন বিরোধী দল নেই।

সেই যে ২০০৮ এ শুরু হয়েছিল মহাজোটের যাত্রা তা আজও অটুট আছে। ২রা জানুয়ারি বিবিসি বাংলার রিপোর্ট বলছে, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করে সংসদে ২য় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় পার্টি যদি কখনো শিরোনাম হয়ও সেটাও হয় হাসির খোরাক। যেমন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ডয়েচে ভেলের শিরোনাম ছিল ‘আসল’ বিরোধী দল হতে চায় জাতীয় পার্টি।

ডয়চে ভেলের এই রিপোর্ট মতে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা প্রকাশ্যেই দশম সংসদের মতো একাদশ সংসদেও সরকারে থেকেই বিরোধী দলে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন? জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বও এজন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘সিগন্যালের’ অপেক্ষায় ছিলেন, কিন্তু না, এবার আর সেই কাঙ্ক্ষিত ‘সিগন্যাল’ দেননি প্রধানমন্ত্রী। তাই হতাশ জাতীয় পার্টিকে বাধ্য হয়ে ‘আসল’ বিরোধী দল হতে হয়। কিন্তু সেই ‘আসল’ হওয়াটা যে কেমন সেটা কলামের শুরুতেই বলেছিলাম। প্রায়ই বিএনপি’র সরকারের সমালোচনার উত্তর দেয়ার দায়িত্ব জাতীয় পার্টি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের কাঁধে তুলে নেয়।

আর যখন সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের আলোচনার প্রসঙ্গ আসে তখন বেশির ভাগ সদস্যই শুরুতে কিছুক্ষণ সরকারের বন্দনা করে নেন। আর সমালোচনা কতো মধুর এবং মোলায়েম হতে পারে সেটা তাদের বক্তব্য শুনলে বোঝা যায়। আশার কথা এই যে, আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি বালুতে মুখ গোঁজা উটপাখির মতো যতোই নিজেকে বিরোধী দল ভাবুক না কেন, এই দেশের সাধারণ নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া কেউই এই দলটিকে বিরোধী দল বলে মনে করে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দুইটি দলের সমন্বয়ে এক নতুন শব্দের উদ্ভব হয়েছে যার নাম ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’। মরিয়া হয়ে সরকার যখন বিরোধী দলের সন্ধান করছে তখন তারা জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টিকে নিয়েও এক খেলায় মাতে। ১৪ দলের নেতারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করুক এটা চেয়েছিল সরকার। যদিও ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া জাসদ কিংবা ওয়ার্কার্স পার্টি বিরোধী দল হওয়াটা মেনে নিতে পারেনি। তারা যৌক্তিকভাবেই বলেছেন- নির্বাচনে তারা মহাজোটের হয়ে সরকারের সাফল্য দাবি করে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। এখন

তাহলে কেন তারা বিরোধী দল হবেন? জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকলেও তারা তাদের নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন, কিন্তু জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি তাদের নিজেদের প্রতীক শিকেয় তুলে নির্বাচন করেছিলেন নৌকা নিয়ে। ভেবে দেখুন তো কেমন লাগে, নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা মানুষরা ক্ষমতায় আছে, আর নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা কিছু মানুষ বিরোধী দলেও আছে। সেই মানুষরা আবার অতি মোলায়েম স্বরে মাঝে মাঝে সরকারের সমালোচনা করে ‘বিরোধী’ দল সাজছে। জ্বি, এটাই আমাদের সংসদ।

১৯৯১ এ সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হবার পর থেকে গণতন্ত্রের এই ধরনটি বাংলাদেশে খুব ভালোভাবে কাজ করেছে এটা বলা যাবে না। এটা কাজ করার পেছনে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এর মতো কিছু শাসনতান্ত্রিক সমস্যা যেমন আছে তেমনি আছে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করার মানসিকতার অভাব। কিন্তু শুরুতেই যেমন বলেছিলাম, বর্তমান এবং এর আগের সংসদটিতে বিরোধী দলের নামে যা ঘটেছে সেটা এই দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্ক হয়েই থাকবে।

মূল বিরোধী দলকে নানা ছলে বলে কৌশলে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে কিংবা ভোটের আগের দিন রাতেই ব্যালটে বাক্স ভর্তি করে সরকার গঠন করে ফেলাই যায়। কিন্তু গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ভিত্তিমূল নির্বাচনকে নষ্ট করে তার ওপর যে শাসন দাঁড়ায় সেটা নির্ভেজাল স্বৈরতন্ত্র। সেই স্বৈরতন্ত্রে গণতন্ত্রের মুখোশ পরানোর জন্য বিরোধী দল বানানোর নামে আলোচিত তামাশাগুলোই হবার কথা।

জোড়াতালি দিয়ে, ফন্দি-ফিকির করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যেতে পারে, তবে গণতন্ত্র হয় না। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত গণতন্ত্র শুধু শাসনপদ্ধতি না, এটা একটা চেতনাও।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়