দীপক চৌধুরী : ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশে এসেছেন- এই ‘নন ইস্যু‘টিকে ‘ইস্যু’ করার জন্য ওঠেপড়ে লেগেছে একটি মহল। যেন তিনি এই দেশে আগমনের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ কেউ। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি। এছাড়া তিনি এদেশে প্রায় তিনবছরের বেশি সময় হাইকমিশনার ছিলেন। দুই দিনের ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সভা করেন। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আমরা জানি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দেবদাস মোদি আসার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে। মুজিব বর্ষেও অনুষ্ঠান কোভিড-১৯-এর কারণে কিছুটা পরিবর্তন করতে হয়েছে। নানান ইস্যুতে কথা বলতে তিনি এসেছেন প্রয়োজনেই। ভ্যাকসিন প্রসঙ্গ তো আছেই। ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন শুরু করবে, এটাও জানি। রোহিঙ্গা ইস্যু, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া, নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় রোহিঙ্গা, মিয়ানমার প্রসঙ্গসহ দুদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কত কথা থাকতে পারে। কিন্তু কেবল প্রশ্ন, ‘তিনি হঠাৎ এলেন কেন?’ সবসময়ই কী ঢাক পিটিয়ে আসতে হয়? দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র আছে। যেমন ঋণচুক্তি, বিদ্যুৎ খাত, অবকাঠামো খাত। আরো কতকিছু। অথচ সর্বত্রই কেবল সন্দেহের বায়ু। কেমন যেন হাস্যকর বিষয়। বিষয়টি আর সাধারণ্যে সীমিত থাকেনি। যখন বিএনপির একাধিক নেতা শ্রিংলা ইস্যুতে নেতিবাচক কথা বলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘একটা বিশেষ দেশের লোক আমাদের উপকার নয়, ক্ষতি করতে আসছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্পর্কে আমাকে আমার ছেলে জিজ্ঞাসা করলো লোকটা কে এবং কেন আসছে? উত্তরে আমি বললাম, সে যখন আমাদের দেশে আসছে, একথাটা মনে রাখতে হবে, আমার দেশের কোনো উপকারের জন্য আসে নাই। সে ক্ষতি করার জন্য আসছে।’ তিনি বলেন, ‘এমন ভাবে তাকে রিসিভ করা হয়েছে- আমার মনে হয়েছে কোনো এক দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে এসেছেন।’
বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল, যে দলটির সিনিয়র নেতাদের অনেকেই মানুষকে ভালবাসতে জানেন না। অপরকে শ্রদ্ধা জানাতে জানেন না। ইতিহাস থেকেই পর্যালোচনা করা যায়, তাদের নেতা জিয়াউর রহমান মানুষকে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করতেন। এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, শত শত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। তাই, যেভাবে হিংসার রাজনীতির জনক হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান- এ বয়ানও আছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের জন্য। বাংলাদেশের জন্য আর দেশটির মানুষের জন্য ত্যাগী এই নেতার আদর্শ ছিল সাদাকে সাদা বলবার। তিনি বুঝতে পারতেন, কাগজে কলমের কোন ঘটনা আসল আর কোনটি নকল। ‘কারো কাছে মাথা নত করতে হবে সত্য বলায়’ তা তাঁর অভিধানে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনীতে অনেক ঘটনাই আমরা পাই। এর বাইরেও তাঁর অনেক ঘটনা আজো প্রাসঙ্গিক। (১৯ আগস্ট, ১৯৭২-এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের একাংশ এখানে উল্লেখ করছি।) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ ছিল একটি উপনিবেশ। এখানে প্রতিরক্ষার কোনো অফিস ছিল না। যা ছিল দু-চার পাঁচজন কর্মচারি নিয়ে। তা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার একটি কানাকড়িও ছিল না। ভারতবর্ষ, রাশিয়া, আমেরিকা, বৃটেন সকলই আমার বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দাবি করতে চাই। তবে কাউকে আমি আমার স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে দিতে চাই না। আজ কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল অযথা ভারতবিরোধী বিষ উদ্গিরণ করে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।.. .. .. .. যুদ্ধের পর আড়াইকোটি মন খাবার ভারতবর্ষ আমাকে দিয়েছে। যেজন্য মিসেস গান্ধীর সরকারকে আজ খাদ্যসংকটে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ খাবার না দিলে আমার বাংলার মানুষ বাঁচতো না। সে আমার প্রতিবেশি রাষ্ট্র। সুখে থাকুক। আমি বাংলাদেশ, সুখে থাকি। সে আমার ভাই, আমি তার ভাই, পাশাপাশি থাকি।’’
কিন্তু সেই নেতাকে ঘাতকরা বাঁচতে দিলো না। এই আগস্টেই তাঁকে হত্যা করলো একদল কুলাঙ্গার। এটা শোকের মাস। এই শোকের মাসেই বিএনপি সরকারের তত্ত্বাবধানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। সেই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। এখনো ৮০ জন নেতা-কর্মী স্প্লিন্টারের আঘাত নিয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন। আর এই হামলার পর মামলা করতে দেয়া হয়নি আওয়ামী লীগ নেতা বা ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনকে। ২০১৩ সালে বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে হরতালের নামে পেট্রল বোমা ছুড়ে শত শত নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল। বিএনপি কীভাবে মানুষ মেরেছিল তা গুগলে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার হুঙ্কার দিয়ে বিএনপি প্রায় আড়াইশ মানুষ হত্যা করেছিল। বিএনপির রাজনীতি নিয়ে তাই মানুষের আগ্রহও কম। তবে সাম্প্রতিকালে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রশাসন। সুতরাং কতিপয় ব্যক্তির অপকর্মের দায় অন্যের ঘাড়ে পড়তে পারে না। দায়ী ব্যক্তিকে কঠিন ও কঠোর আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। অর্থাৎ দোষীকে ছাড় দেওয়া যায় না। করোনাকালে এটাই হোক সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ।
বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের ফানুস উড়িয়েই শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় বসেন ১৯৯৬-এ। এরপর টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। মোট চারবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ১২ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো এবং ২০১৯ এর জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ও হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুত্তি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন দেশের ভেতর-বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও প্রশংসিত। জ্বালাও- পোড়াও, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাসহ দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, বাধা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগোতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, ক্রীড়া, পরিবেশ, কৃষি, খাদ্য, টেলিযোগাযোগ, সংস্কৃতি, সামাজিক নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, মাতৃত্ব এবং শিশু স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ এমন কোনো খাত নেই যে খাতে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। নারী হলেও মেধা-যোগ্যতার কারণে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, উপমহাপরিদর্শক, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাপদে নারীদের কর্ম নিয়ে আমরা কখনওবা গর্ব করেও থাকি।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি ও কথাসাহিত্যিক