কামরুল হাসান: গুলি ভরা পিস্তলটি ড্রয়ার থেকে বের করে ম্যাগজিন খুলে সেটা আবার চেম্বারে ঢুকিয়ে রাখলেন । এরপর সেই অস্ত্রটি টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে বললেন, বলেন কি জানতে চান?
সামনে বসা লোকটার কী অবস্থা একবার ভাবুন। প্রাণের মায়া কার নেই! দরদর করে ঘামছি। এই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থার মধ্যে প্রশ্ন আর কী করব । মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, কীভাবে সব সামলে নিয়ে যমের খাঁচা থেকে বেরোব।
পুলিশের পিস্তল কেনা নিয়ে এর আগে একটি রিপোর্ট করেছিলাম। চীন থেকে সস্তায় কেনা সেই পিস্তল রাজারবাগে পরীক্ষা করাতে নেওয়া হয়েছিল। দেখা গেল, এক রাউন্ড ফায়ার করলেই তেতে আগুন। পিস্তল আর হাতে রাখা যায় না। শেষে পানিতে চুবিয়ে ঠান্ডা করতে হয়। সেই রিপোর্ট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির সময় অস্ত্র বিষয়ক কিছু তথ্য মুখস্থ হয়েছিল। প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে সেগুলোই আওড়াতে লাগলাম, যেন তিনি মনে করেন অস্ত্রের ব্যাপারে আমার অগাধ জ্ঞান।
অস্ত্র বিষয়ক সেই ‘জ্ঞান’ বিলানোতেই মনে হলো কাজ হচ্ছে। তিনি যেন একটু নরম হলেন। টেবিল থেকে অস্ত্রটি সরিয়ে ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললেন, শুনেছিলাম, আপনি নাকি বেশ হোমরা চোমরা। এখনতো দেখি হাবাগোবা। বলেই একজনকে বললেন, এই ভাইকে ‘ঠান্ডা’ দে । তখন পেপসি বা কোকাকোলাকে অনেকে ঠান্ডা বলতেন। এল কাচের গ্লাসে বুদ্বুদ ওঠা ঠান্ডা কোক আর প্যাটিস। শুনেছি, খাবার খেলে ভয় কমে। এই ভেবে গবগব করে খেতে শুরু করলাম, কিন্তু ভয় আর কমে না।
যে লোকটির কথা এতক্ষণ শুনলেন, তার নাম আমিন রসুল সাগর। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি ‘টোকাই সাগর’ নামে পরিচিত ছিলেন । গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের তিন তলার আমিন রসুল ট্রেডার্সে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিকও ছিলেন তিনি। সেটা ২০০০ সালের কথা। আমি তখন দৈনিক জনকণ্ঠে। আর টোকাই সাগর ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। শোনা যায়, বিএনপির এক নেতাকে অকশানে কেনা একটি জিপ উপহার দিয়ে তিনি এই পদটি পেয়েছিলেন।
সাগরের সঙ্গে আমার আলাপটি ছিল প্রায় দেড় ঘণ্টার। কী কী অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছিলাম তার সব মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। বলছিলেন, যুবলীগ নেতা আওরঙ্গ ও শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য এসব করেছেন। পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে যেসব খবর লেখা হচ্ছে, সবই তাদের সরবরাহ করা। এমনকি তার নামের শেষে ‘টোকাই’ উপাধিটাও লিয়াকতের দেওয়া বলে দাবি করেছিলেন।
এই সাক্ষাতের পরদিন জনকণ্ঠে টোকাই সাগরকে নিয়ে যে রিপোর্টটি করেছিলাম সেখানে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখানোর কথাটা এড়িয়ে যাই। আসলে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার চেয়ে পাছে কোনো বিপদ হয় সেটা ভেবে আমি অস্ত্রের কথাটা বলিনি। সেই নিউজে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও খুব সতর্ক ছিলাম।
নিউজটি ছাপা হওয়ার দিন আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে এক নারী আসেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে দুটি ফুটফুটে বাচ্চা। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। বাচ্চা দুটির একজন বিআইটিতে, অন্যজন আইআইটিতে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মুখে বাংলা আসে না। যে নারী এসেছিলেন তিনিও খুব স্মার্ট ও সুন্দরী। মার্জিত পোশাক, কথাতেও ভীষণ বিনয়ী। পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম মাহবুবা রসুল লিপি, তিনি সাগরের স্ত্রী। তাঁর বাবা আগারগাঁও কৃষি ইনস্টিটিউটের চাকুরে, পারিবারিক সম্মতিতেই তাদের বিয়ে হয়েছে। সাগরের আগের দিনের ব্যবহারের জন্য তিনি ক্ষমা চাইতে এসেছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এত লোক বাদ দিয়ে সন্ত্রাসীকে কেন বিয়ে করলেন? তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হাসলেন।
এই নারীকে ভালো করে দেখলাম, সাগরের সঙ্গে তাঁকে কোনো ভাবেই মেলানো যায় না। বিদায়ের সময় আমি তাকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। এ সময়ও তিনি বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলেন। আমার ভয় কেটে গেল, মনে হল একটু নিরাপদ হলাম।
তবে আমি নিরাপদ হলেও ভয়ে ভয়ে ছিলেন আমার বন্ধু যুগান্তরের সাংবাদিক ফকরুল আলম কাঞ্চন (এখন এনটিভিতে)। ২০০০ সালের শেষের দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয় চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটির সভার সূত্র ধরে টোকাই সাগরের বিরুদ্ধে যুগান্তরে কয়েকটি নিউজ করে কাঞ্চন। একটি নিউজের হেডিং ছিল ‘কোটিপতি টোকাইকে খুঁজছে পুলিশ’ । এই নিউজটি ছাপার পর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় টোকাই সাগর। কাঞ্চনকে নানাভাবে হুমকি দেয়। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে। সাগরের মুক্তির বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় কেবলই সময়ের ব্যাপার। মুক্তি আসন্ন বিবেচনা করে তিনি কাঞ্চনের ওপর হামলার ছক কষেন।
কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন ডেপুটি জেলার নেছার উদ্দিন মুকুল (এখন গাজীপুরে) এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন। এ নিয়ে যুগান্তরের সেই সময়ের সম্পাদক (প্রয়াত) গোলাম সারওয়ার বিএনপির তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। আলতাফ হোসেন চৌধুরী টোকাই সাগরকে আরও কিছুদিন জেলে আটকে রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বেশি দিন আটকে রাখা যায়নি। সে গল্পে পরে আসছি।
টোকাই সাগরকে নিয়ে আমি প্রথম বড় একটি নিউজ করি ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে। সেই নিউজ নিয়েও কম ঝামেলা হয়নি। এর কিছুদিন পর ডিবি পুলিশের হাতে মেধাবী ছাত্র রুবেল নিহত হয়। এটা মনে আছে, বিমানবন্দর থেকে পাচার করা একটি সোনার চালান টোকাই সাগরের লোকজন মেরে দিয়েছিল। এই চালানটি ছিল কলকাতার এক ব্যবসায়ীর। পুলিশের কাছে তথ্য ছিল চালানটা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মহাখালী হয়ে সোনার পাইকারি বাজার তাঁতিবাজারে চলে যাবে। চালান ধরতে পুলিশ ওত পেতে ছিল বিমানবন্দর মোড়ে। ঠিক সময়ে সোনার চালানটি বিমানবন্দর থেকে বের হলেও ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটের মুখে টোকাই সাগরের লোকজন আটকে দেয়। সোনার বাহকেরা তাদের পুলিশের লোক ভেবে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। সেই সুযোগে সোনা নিয়ে এখন যে পথ দিয়ে র্যাব সদর দপ্তরে যেতে হয়, সেই পথ দিয়ে উত্তরা ১ নম্বরে দিকে চলে যায় টোকাই সাগরের লোকজন।
এই সোনা ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে ওই সময় বেশ হইচই হয়েছিল। মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে গেলেই এ নিয়ে কথা শুনতাম। একদিন গোয়েন্দা পুলিশের এসি মিয়া আবদুস ছালাম (বর্তমানে অবসরে) আমাকে বললেন, ওই চালানে নাকি ২০ কেজির মতো সোনা ছিল। কিন্তু প্রমাণ না থাকায় অন্ধকার জগতের জিনিস অন্ধকারেই হারিয়ে যায়।
সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে ঢাকা বরাবরই ছিল ট্রানজিট রুট। সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া থেকে উড়োজাহাজে করে টন টন সোনা নামে ঢাকায়। সেই সোনা চলে যায় ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে। পাচারের পুরো কাজটি যেহেতু আন্ডারগ্রাউন্ডে হয় সে কারণে কোনো তথ্য ফাঁস হলেই পাচারকারীদের সর্বনাশ হয়ে যায়। তখন পাচারের সোনা চলে যায় পুলিশ বা সন্ত্রাসীর হাতে। আবার অভিযানের নামে পুলিশের অনেক টিম পুরো সোনার চালান গায়েব করে দেয়—এমন ঘটনাও ছিল । পুলিশের ভাষায় একে বলা হতো ‘গোল্ড সামারি’ ।
বিদেশে থেকে আসা সোনার চালান কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যে দুজন সন্ত্রাসীর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল তার একজন হলেন মুরগি মিলন, অন্যজন টোকাই সাগর। এক সময় দুজন একসঙ্গে এ কাজ করেছেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় টোকাই সাগর বলেছিলেন, ‘লিয়াকত-মিলনের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল । মগবাজার মোড়ে বিএনপির মিছিলে হামলার আগে পর্যন্ত তাদের বাসায় দাওয়াতও খেয়েছি।’
টোকাই সাগর নিয়ে সবচেয়ে বেশি খবর জানতেন সিটি এসবির ওই সময়ে স্পেশাল অপারেশন বিভাগের এএসপি খলিলুর রহমান ভূঁইয়া (এখন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী) এবং ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বংশধর তৎকালীন ওসি ওয়াচ মীর নাজমুল হক (এখন অবসরে) । কোনো খবর পেলেই আমি তাদের কাছে গিয়ে ক্রস চেক করে নিতাম। মোটা মোটা ফাইল দেখে তারা সব ঠিক করে দিতেন। সেসব ফাইলে টোকাই সাগরের জীবন বৃত্তান্তও ছিল।
পুলিশের খাতা অনুযায়ী টোকাই সাগরের জন্ম সন্দ্বীপের বাউরিয়া গ্রামে। তার বাবা সাগরে মাছ ধরতেন। সাগরের আসল নাম ছিল আমির হোসেন। টোকাই সাগর আমাকে বলেছিলেন, তিনি সন্দ্বীপের বাউরিয়া হাইস্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাড়ি ছাড়েন।
কিশোর বয়সে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী মার্কেটে চলে আসেন সাগর। সেখানে এক মাস্তানের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ৮৬ সালে কর্ণফুলী মার্কেটের চাঁদাবাজি নিয়ে এক যুবক খুন হয়। সেই মামলায় সাগরের নাম আসে। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। আগারগাঁও বস্তি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে নিজের নাম বদলে রাখেন আমিন রসুল সাগর। এখানে এসেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৯ সালে ডাকাতির অভিযোগে ডিবির এসি ফজলুল করিম তাকে গ্রেপ্তার করেন। টোকাই সাগরের সেই ছবি ১৯৮৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকে প্রথম পাতায় ছাপা হয়। এখানে বলে রাখি, ফজলুল করিমকে বলা হতো ডাকাত দলের “এনসাইক্লোপিডিয়া” । সিআইডি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০১৩ সালে ২৯ আগস্ট রামপুরার বাসায় নিহত হন এই ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা।
শোনা যায়, জেলে যাওয়ার পর সাগরের সঙ্গে ছাত্রদল ক্যাডার নীরু ও বি. সেলিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। বি. সেলিম পরে ‘বাস্টার্ড সেলিম’ নামে পরিচিত পায় । তারা সাগরকে অস্ত্র সংগ্রহের কাজে লাগায়।
এরশাদ সরকার পতনের পর আগারগাঁও থেকে আস্তানা গুটিয়ে আশকোনায় চলে যান সাগর। সেখান যাওয়ার পর বিমানবন্দর এলাকার অনেকের সঙ্গে তার সখ্যতা হয়। সিভিল অ্যাভিয়েশনের এক কর্মচারীর মাধ্যমে সোনা চোরাচালানি ‘গোল্ড মজিবরের’ সঙ্গেও পরিচয় হয় সে সময় । মজিবরের হাত ধরেই সোনা চোরাচালানের কাজে নেমে পড়েন সাগর।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয় বাস্টার্ড সেলিম, সাগরের জন্য সেটা পোয়াবার হয়ে যায়। তখন বি সেলিম, গোল্ড মজিবর ও টোকাই সাগর একসঙ্গে সোনা চোরাচালানের কারবার করেন।
৯৪ সালে সাগরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন পর যথারীতি তিনি ছাড়া পান। ৯৫ সালে বিমানবন্দরে গোলাগুলির সময় অস্ত্রসহ ল্যাংড়া রফিক ধরা পড়েন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সাগরকে গ্রেপ্তার করে ডিটেনশনে দেওয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে কাওলার কামালের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। কামাল গুলিতে আহত হলে এলাকার লোকজন সাগরকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। কিন্তু এরই মধ্যে বিমানবন্দর এলাকায় নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন সাগর। বিমানবন্দরের গাড়ি পার্কিং ও কনকর্স হল ইজারা নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেন। ওই সময়ে একটি বড় সোনার চালান নিয়ে গোল্ড মজিবরের সঙ্গে তার বিরোধও বাঁধে। মজিবরকে ভয় দেখাতে তার বাড়ি গিয়ে পোষা কুকুরকে গুলি করে চলে আসেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুবলীগের লিয়াতক ও মুরগি মিলনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন সাগর। তারা বেশ কিছুদিন একসঙ্গে কারবার করেন। পরে সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগ আমলে সাগরের হাত থেকে বিমানবন্দরের ইজারা চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মায়ার ছেলে দীপু চৌধুরীর হাতে। এতে মুরগি মিলনের লাভ হয়। মিলন আবার বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন। এই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাগর ও মিলনের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। পরে কালা জাহাঙ্গীর ও সুব্রত বাইনের সঙ্গে মিলে মুরগি মিলনকে খুন করেন সাগর। মিলন খুন হওয়ার পর সাগর একটি পত্রিকাকে বলেছিলেন, মিলন হত্যায় তিনি জড়িত ছিলেন না। মামলায় তার নাম ঢুকিয়েছিলেন লিয়াকত ও আওরঙ্গ।
পুলিশের খাতায় সাগরের বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১২টি, সব মামলায় তিনি জামিন পেয়েছিলেন। সোনা চোরাচালানের টাকায় সে সময় তিনি গুলশানে একটি ফ্ল্যাট ও নিকুঞ্জে একটি প্লট কেনেন। আশকোনায় তার একটি চারতলা বাড়িও ছিল। ল্যান্ডক্রুজার গাড়িতে চলাফেরা করতেন। ঢাকাই সন্ত্রাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তবান ছিলেন টোকাই সাগর।
২০০১ সালের ৩ এপ্রিল দুবাই থেকে ঢাকা ফেরার পথে সাগরকে গ্রেপ্তার করেন এসবির সাবইন্সপেক্টর রেজা । তিনি ছিলেন এএসপি খলিলুর রহমানের টিমের সদস্য। সাগরকে নিয়ে যাওয়া হয় ১০-এ নিউ বেইলি রোডের সিটি এসবি অফিসে। তখন এসবির বিশেষ সুপার (এসএস) ছিলেন ইমামুল হক ফিরোজ (এখন হাইকোর্টের আইনজীবী)। আর এখনকার অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুব হোসেন ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। এসএসের রুমে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বসা। আমাদের সামনে টোকাই সাগরকে আনা হয়। ঠিক এ সময় সেই কক্ষে আসেন যুগান্তরের ফকরুল আলম কাঞ্চন। তাকে দেখে মাহবুব হোসেন নাম ধরে ডাক দেন। কাঞ্চনের নাম শুনে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে টোকাই সাগর। খিস্তি করে বলেন, ...তোকে আমি দেখে নেব।
দিনকয়েক আগে মাহবুব হোসেন বললেন, কাঞ্চনের নাম বলার পর টোকাই সাগর যেভাবে চোখ লাল করেছিল সেটা এখনও মনে আছে।
টোকাই সাগরকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর জেলে পাঠানো হয়। বেশ কয়েক মাস জেলে থাকেন। এরপর একদিন সবার অজান্তে জামিনে বেরিয়ে আসেন। আমরাও নানান ইস্যুর ভিড়ে তাকে ভুলে যাই।
বেশ কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় টোকাই সাগরের স্ত্রী ফোন করেন। তিনি বলেন, তার দেবরের স্ত্রী ডিভি-ওয়ানে আমেরিকা গেছে। তারাও পরিবার নিয়ে একেবারে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমার কাছে আবারও সেই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। আমি তার ফোন রাখি আর ভাবি, সবার চোখের সামনে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন শীর্ষ চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসী টোকাই সাগর। এত অপরাধ করেও তাকে কোনো বিচারের মুখোমুখি হতো হলো না।
টোকাই সাগরের দেশ ছাড়ার এক-দুই মাস পরে ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। সে তালিকায় টোকাই সাগরের নামও ছিল। সাগর তত দিনে লংআইল্যান্ডে বাড়ি কিনে জাঁকিয়ে বসেছেন।
এই লেখাটা শেষ করতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেল আরও বছর চারেক আগের ডাক বিভাগের একটি ঘটনার কথা। ডাক বিভাগের বৈদেশিক শাখায় তখন খুব চুরি হতো। ডিএইচএল বা ফেডএক্সের মতো আন্তর্জাতিক কুরিয়ার অত সহজলভ্য ছিল না। সাধারণ মানুষের ভরসা ছিল ডাক বিভাগের পার্সেল সার্ভিস। প্রবাসীরা পার্সেল সার্ভিসে করে যেসব পণ্য স্বজনদের কাছে পাঠাতেন, ডাক বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারী তার কিছু সাবাড় করে দিতেন। ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটত, তবে বড় চুরির ঘটনা হলে থানা-পুলিশ করা হতো। তখন ক্রাইম রিপোর্টারেরাও খবর পেত।
এ রকম একটি চুরির ঘটনা কাভার করতে গেছি ডাক বিভাগে। তো সব দেখেশুনে কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিতে গেলাম ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেলের রুমে। এই পদে তখন ছিলেন নামকরা রম্যলেখক আতাউর রহমান। তাঁর কক্ষের দরজা খোলা দেখে ঢুকে পড়লাম। তিনিও খুব ভালো ব্যবহার করলেন এবং সময় দিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
কথা শেষে বেরিয়ে আসার মুখে আমার একটা ভিজিটিং কার্ড চাইলেন। মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তাঁর হাতে দিতেই সেটার দিকে তাকিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। ডান হাত দিয়ে টেবিলের ওপরে একটি চাটি মেরে বেশ উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, ‘আরে..আপনি ক্রাইম রিপোর্টার? আমি জীবনে প্রথম ক্রাইম রিপোর্টার দেখলাম । আমার ধারণা ছিল ক্রাইম রিপোর্টারেরা দেখতে চোর চোর!’
এ রকম একজন উচ্চপদস্থ আমলা ও লেখকের মুখে এমন কথা শুনে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-তো স্যার আমি দেখতে কি রকম? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে চট বলে দিলেন, ‘আপনি দেখতে বোকা বোকা । আপনার চেহারার মধ্যে একটা হাবাগোবা ভাব আছে।’
আমি ভেবে ছিলাম আমাকে নিয়ে ভালো কিছু বলবেন । তখন বয়স কম, একটুতেই মন খারাপ হয়। সেই খারাপ মন নিয়ে অফিসে গিয়ে আমার বস, বড় ভাই শংকর কুমার দে-কে সব বললাম। তিনি শুনে বললেন, ‘মন খারাপ কইরেন না । ক্রাইম রিপোর্টারদের ভাবমূর্তি অনেকটা পুলিশের মতো, কেউ ভালো চোখে দেখে না।’
একবার মনে হলো হয়তো দাদার কথা ঠিক, আবার মনে হলো দাদা এটা আক্ষেপ থেকে বলছেন ।
সেই ঘটনার ঠিক চার বছর পর, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চোরাকারবারি টোকাই সাগরের মুখে ‘হাবাগোবা’ শব্দটি শুনলাম । এবার আর মন খারাপ হলো না। বরং মনে হলো, আসলেই বোধ হয় আমার চেহারায় একটা হাবাগোবা ভাব আছে। ওই দুজনই কেবল মুখের ওপর বলেছেন, বাকিরা ভদ্রতার খাতিরে বলেন না।
‘হাবাগোবা’ চেহারার আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি, আর টোকাই সাগর নিশ্চয় আমেরিকায় মহানন্দে জীবন পার করছেন । ফেসবুক থেকে