দুলন চৌধুরী : বাউল শিল্পী রণেশ ঠাকুরের গানেরঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অনেকেই। এরমধ্যে রয়েছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, শিল্পকলা একোডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি, স্থপতি ও কথাসাহিত্যিক শাকুর মজিদ, লন্ডন প্রবাসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গৌরি চৌধুরী, সাংবাদিক উজ্জ্বল দাশসহ দেশ-বিদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠক, বোদ্ধারা।
রণেশ ঠাকুরের গানেরঘর অগ্নিকাণ্ডে পুড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, এদেশের বাউল সাধক ও বাউল সমাজ কী ভয়ঙ্কর রকমের আগুনের ওপর আছেন। গত ১৭ মে দিবাগত রাত দুটোর দিকে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের বাউল রণেশ ঠাকুরের বাড়ির গানেরঘর আগুনে ভস্মিীভূত হয়ে যায়। এসময় হুলস্থূল ও চিৎকার শুরু হলে গ্রামের প্রতিবেশি সমাজসেবক দ্রুপদ চৌধুরী নূপুর, বাউলসম্রাট আবদুল করিমের পাড়ার লোকজন ও প্রতিবেশি আরেকটি পাড়ার লোকজন আসেন এবং তারা প্রায় তিনঘন্টার চেষ্টায় আগুন নেভাতে সক্ষম হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এই অগ্নিকাণ্ড ছিল অস্বাভাবিক, পরিকল্পিত। কারণ, এ আগুন নেভাতে তাদের মারাত্মক বেগ পেতে হয়েছিল। আকাশের দিকে প্রায় ত্রিশ হাত উঠেছিল এ আগুন। সব ধরনের বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন গানের খাতা পুড়ে যায়। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ঘটনার পর সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, দিরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সফি উল্লা, দিরাইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলায়েত শিকদার, দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম নজরুল, ওসি (তদন্ত) আকরাম সহ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। জেলা প্রশাসক তিন বান টিন দেন। ইউএনও মো . সফি ২০ হাজার টাকা দেন।
জেলা প্রশাসক বলেছেন, ‘প্রশাসন রণেশ ঠাকুরের পাশে আছে। আশ্বস্ত করে জেলার পুলিশ সুপার বলেছেন, ‘ ক্ষতিগ্রস্ত বাউল সুবিচার পাবেন।’ সুনামগঞ্জ থেকে প্রথম আলো জেলা প্রতিনিধি খলিলুর রহমান, সমকাল প্রতিনিধি ও সুনামগঞ্জের খবরের সম্পাদক পঙ্কজ দেসহ বিভিন্ন সাংবাদিক ও বাউলবান্ধব ব্যক্তিরা ঘটনাস্থলে আসেন। বাউল রণেশ ঠাকুর ‘ভাটিবাংলা বাউল একাডেমী ও গবেষণা কেন্দ্রে’র সাংস্কৃতিক সম্পাদক। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রণেশ ঠাকুর বাউলগানে প্রতিটি অন্যায় ও অপকর্মের প্রতিবাদ করেছেন বিভিন্ন সময়। ওয়ান ইলেভেনের (জরুরি আইনের) সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এই বাউল সংগঠনটি ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গান পরিবেশন করে।
এসময় বাউল রণেশ ঠাকুর ও তার সঙ্গীরা সেখানে গান করেন। এরপর এই বাউল সংগঠনের পক্ষে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে, ঢাকা ক্লাবে, ঢাকা ক্যাডেট ক্লাবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গান পরিবেশন করে। অতীতে শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে এবং গানেরঘরেও হামলা চালানো হয়েছিল। এই দরদী ও মরমী বাউলের দর্শন ও আদর্শ আমাদের ভাবিয়ে তুলে। অথচ তিনিও রেহাই পাননি। তবে এটা সত্য, বাউল রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে আসরঘরে আগুনের ঘটনাটি এ সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, বাউলদের সংকট মারাত্মক, তারা ঝুঁকিতে। সবশ্রেণির সাধারণ মানুষ বাউলদের সঙ্গে আছে বলেই হয়তো তারা টিকে আছেন। চমৎকার সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী এ বাউল গত জাতীয় নির্বাচনের সময় ভাটি বাংলা বাউল একাডেমীর পক্ষে বহু গান করেছেন। এই সংগঠনের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাউলগান পরিবেশন করেন। । আমরা জানি, বাউল দর্শন বাংলার জনপদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও লোকাচার হিসেবে যার চর্চা বাংলার মাটিতে হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে ।
২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে বাউল গানকে অন্যতম সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাউলেরা বৃহত্তর মানবতার গান গেয়ে থাকেন বলেই সেজন্যই উগ্র শক্তি পরিকল্পিতভাবে বারবার বাউলদের উপর হামলা চালায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সাস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছেন, ‘সরকার ও জনগণ যখন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক্যবদ্ধভাবে সংকটকাল অতিক্রমণে ব্যস্ত তখন সাম্প্রদায়িকশক্তি এ হীন কাজে লিপ্ত রয়েছে। সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অধিদপ্তরের কাছে আহ্বান জানাই, অনতি বিলম্বে এই জঘন্য কর্মের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হোক।’
লেখক : সম্পাদক, ভাটিবাংলা বাউল একাডেমী ও গবেষণা কেন্দ্র