জাকারিয়া মাসুদ, ফেসবুক থেকে : সব ঘরেই কোলাহল শোনা যায়। খুনশুটির আওয়াজ পাওয়া যায়। কেবল এই একটি ঘরই নীরব। শুনশান।
এই ঘরে এখন আর আগের মতন লোক আসে না। দুপুরবেলাকার তালিমের আওয়াজ শোনা যায় না। মুসুল্লিদের পদভারে কম্পিত হয় না এই ঘরের পাপুস। জলকলকল শব্দে এখানকার ওযুখানা মুখরিত হয় না। ‘আইন’-এর উচ্চারণ করতে গিয়ে যে শিশুগুলো হেসে উঠত বারে বারে, তারাও এখন আর হাসে না। জামাতের সময় যে ঘরের বারান্দাতেও ঘনবর্ষার মতন মানুষের ঢল নামত, সে বারান্দাও এখন চৈত্রের শুষ্ক মাঠের মতো খাঁ-খাঁ করছে। কাঠফাটা জমিনের মতন হয়ে গেছে ঢেউখেলানো সিঁড়িগুলো। প্রাচীরের চারিদিকে কেমন জানি স্যাঁতস্যাঁতেভাব। বারান্দার চারিদিকে বাসা বেঁধেছে মাকড়সার দল।
এই ঘরে এসে মানুষগুলো তার দুঃখ-কষ্ট নিবেদন করত ঘরের মালিকের কাছে। ফজরের পর থেকে ইশরাক অবধি যিকির-আযকার হতো এখানে। ইশরাক থেকে নিয়ে নাস্তার সময় অবধি বাচ্চারা তিলাওয়াত করত মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে। অনেক দূর থেকে সে আওয়াজ শোনা যেত। এই বাচ্চারাও আজ আড়ি জানিয়েছে। হুজুরের অগোচোরে ওদের দুষ্টুমিগুলো চোখে পড়ে না এখন। ওদের তিলাওয়াতের লহরি শোনা যায় না, সে অনেক দিন হলো।
সপ্তাহখানিক আগেও এই ঘরের হৃদয়গগণে শেষরাত্তিরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠত। সেই চাঁদে আলোকিত থাকত কার্পেটে-ঢাকা-মেঝে। এখন আর এখানে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে না। চাঁদের কিরণ খেলা করে না মেঝেজুড়ে। ঘরটা তালাবদ্ধ থাকে রাত্রীর শেষভাগে। কোনো তাহাজ্জুদগুজার মানুষের নাগাল পায় না সে। সেই কারণে এই ঘরে জোছনাও আসে না।
এই ঘর থেকেই ওহির আলো ছড়িয়ে যেত সমাজে। আল্লাহভোলা লোকগুলো আল্লাহর পথের পথিক হতো। এই ঘরেই জন্ম হতো মুত্তাকি ও মুহসিন বান্দাদের। হিদায়াতের নির্মলরশ্মি এখানেই এসে খেলা করত আপনমনে। এই রশ্মি তার পবিত্র আভা ছড়িয়ে দিত দিগ্দিগন্তে। আঁধারে-ঢাকা-সমাজ সেই আলোকোজ্জ্বল বিচ্ছুরণ থেকেই চিরবন্ধুর পথে সফর করবার সাহস জোগাত। তাকবীরের ধ্বনিতে ঈমানকে তাজা করত মহল্লার লোকেরা।
আজ এই ঘর কোলাহলশূন্য। যেই ঘর উন্মুক্ত ছিল জনতার জন্যে, আজ সে ঘরে পাঁচজন ছাড়া কেউই প্রবেশ করতে পারে না। কেবল জুমার দিনে এর ব্যতিক্রম হয়। তবে এই ব্যতিক্রমটাও কেন জানি অদ্ভুত-ব্যতিক্রম বলেই মনে হয়। যে-জুমুআয় এখানে তিল ধারণের ঠাঁই হতো না, আজ সেখানে দশজনের বেশি জমায়েত হতে পারে না। যে খুতবা শোনার জন্যে দূর-দূরান্ত থেকে লোজন ভিড় করত এখানে, সেই লোকগুলোও এখন আর আসতে পারে না। পথ বন্ধ। লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে।
কোলাহলহীন এই ঘর কেঁদে কেঁদে অশ্রু ঝরায় নীরবে, নিভৃতে। তার হৃদয়টা হাহাকার করতে থাকে তিলাওয়াতের গুঞ্জরণ শোনার জন্যে। দেওয়াল থেকে ভেসে আসে হু-হু আওয়াজ। দুরুদুরু-বক্ষে সে আর্তনাদ করে বলতে থাকে, “ওহে মুসুল্লিরা! তোমরা কি এখানে এসে এতদিন মেকি কান্না দেখাতে? মুনাফিকদের মতন ইবাদাত করার ভান করতে? তোমাদের গোনাহের জন্যেই আমার আজ এই দশা। এই-যে আযাব, এটা তো তোমাদেরই দু-হাতের কামাই। এখনও রহমানের দিকে ফিরে আসবে না? তোমরা না-ফিরে এলে যে আমার হাহাকার ফুরোবে না কখনও।”
পঙ্কিলসাগর থেকে ওঠে এসে মুসুল্লিরা যেদিন স্নান করবে ঈমানের পবিত্রসরোবরে, সেদিনই বোধহয় দয়াময় আবার এই ঘরকে প্রাণবন্ত করে দেবেন। আবারও এখানে কুরআনের আসর জমবে। খতিবের অগ্নিঝরা কণ্ঠ ধ্বনিত হবে মিম্বার থেকে। রহমানের বান্দারা অনুতপ্ত-অশ্রু ঝরাবে সাজদায় গিয়ে। আবারও পূর্ণিমার চাঁদ খেলা করবে এই ঘরের হৃদয়াকাশে। নামাজিদের সুমধুর কলকাকলিতে মুখরিত হবে এখানকার আঙিনা। আবারও একদিন মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ শুনে এই ঘরের দিকে দলবেঁধে হাঁটা দেবে মুসুল্লিরা। গোধূলির মিষ্টি আলোতে চঞ্চল শিশুরা ছন্দে ছন্দে বলবে, ‘আলিফ যব আ, ‘বা যবর বা’...
তখন কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না। কড়াকড়ি থাকবে না। থাকবে না কোনো লকডাউন।
আবারও হেথায় গাইবে বিহঙ্গম প্রাণজুড়নো সুরে
মুসুল্লিদের কলকাকলিতে প্রাঙ্গন উঠিবে ভরে
কুরআনের ধ্বনি ছড়িয়ে যাবে আবার এই আঙিনায়
মেঝেতে হেথায় করিবে খেলা নিশিথের জোছনায়