ফজলুল বারী: নজিরবিহীন দাবানলে পুড়েছিলো অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি। এরপর আবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নাজুক অবস্থায় পড়েছে অর্থনীতির নানা খাত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কবে হবে তা কেউ জানে না। এ অবস্থায় নাগরিকদের ভয় তাড়াতে নানা অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। পেনশনার, নিম্ন আয়ের মানুষজন, বেকারদের এককালীন ৭৫০ ডলার করে দেওয়া হবে। আগামী ৩১ মার্চ থেকে এ অর্থ যেতে শুরু করবে তালিকাভুক্তদের ব্যাংক একাউন্টে। ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সচল রাখতে, কর্মচারীদের বেতন দিতে সহায়তা হিসেবে এককালীন দেওয়া হবে ২৫ হাজার ডলার। বিরূপ পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচিতে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করবে এই কল্যাণ রাষ্ট্র। এছাড়া দাবানলের ক্ষত থেকে দেশকে ফেরাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বিশেষ প্যাকেজ কর্মসূচি। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় ১২৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। বিরূপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার এমন টাকা দেওয়ার প্রণোদনা কর্মসূচি অবশ্য এবারেই প্রথম নয়। এর আগে কেবিন রাডের লেবার সরকারের সময় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় নাগরিকদের ভয় তাড়াতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের ব্যাংক একাউন্টে দু’দফায় ৯৫০ ডলার করে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিলো। এ ব্যাপারে সরকারের চিন্তাটি হচ্ছে লোকজনের পকেটে টাকা থাকলে তারা মার্কেটে শপিংমলে যাবে। কেনাকাটা করবে। এতে করে বাজার চাঙ্গা থাকবে। সিডনিতে ওই সময়ে রোববারে ‘ফ্যামিলি ফান ডে’ নামের নতুন একটি টিকিট চালু করা হয়। আড়াই ডলারের টিকিটে রোববার সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ট্রেনে-বাসে-ফেরিতে যতো খুশি ভ্রমণ করা যায়। এর পেছনে সরকারি চিন্তাটি হলো লোকজন সপরিবারে ঘর থেকে বেরোলে বাইরে খাওয়াদাওয়া, ড্রিংস কেনাসহ নানা কেনাকাটায় থাকবে সারাদিন। এতে করে চাঙ্গা থাকবে বাজারও। রোববারের সেই ফ্যামিলি ফান ডে তথা সারাদিন ধরে ভ্রমণের আড়াই ডলারের টিকিট এখনো চালু আছে।
করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে এবারেও এমন নানা অর্থনৈতিক প্যাকেজ নিয়ে ভাবছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। চীনের সঙ্গে এই দেশটার অর্থনীতি নানাসূত্রে বাঁধা। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগ চীনাদের নিয়ন্ত্রণে। এখন চীন যেহেতু বিপদে সে কারণে অস্ট্রেলিয়া দেশটার উদ্বেগও বেশি। চীনা পর্যটক বেশি ভ্রমণে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের পচাত্তর শতাংশ ছাত্রছাত্রীই চীনা। সে কারণে পর্যটন ও শিক্ষা খাতে বিপুল ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু সবার আগে তো নাগরিকত্বের নিরাপত্তা। এ কারণে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালির সঙ্গে সব ধরনের যাতায়াত বন্ধ। প্রতি সপ্তাহে এই ট্র্যাভেল ব্যানের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের সব দেশের সঙ্গে একমাসের ট্র্যাভেল ব্যান ঘোষণা করেছেন। এই খবর আসার পর অস্ট্রেলিয়াও এ ধরনের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়া আবার সব কিছুতে আমেরিকাকে অনুসরণ করে।
তবে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার স্বস্তির প্রধান জায়গাটা হচ্ছে খাদ্যসহ প্রধান ভোগ্যপণ্যের বেশিরভাগ অস্ট্রেলিয়াতেই উপন্ন হয়। চাল, আটা, ময়দা, ডাল, চিনি, আলু, শাকসবজি, পেঁয়াজ-রসুন থেকে শুরু করে দুধ, মাংস, মাছ, ফলমূল কোনো কিছুর জন্য বিদেশের কথা ভাবতে হয় না। বরঞ্চ এসব নানা কিছু নিয়মিত বিদেশে রপ্তানি করে। করোনা পরিস্থিতির কারণে রপ্তানি নিয়ে বেড়েছে দুশ্চিন্তা। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত খামারের গরু, ছাগল,ভেড়া-শূকরের মাংসের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ছিলো চীন।
অস্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত মদও চীনাদের বিশেষ পছন্দ। কিন্তু চীনের সঙ্গে এখন নানা যোগাযোগই ভেঙে পড়ছে। করোনার ভয়ে বিশেষ প্রভাব পড়েছে নানা সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে। চুল কাটার সেলুন, বার-নাইট ক্লাব, সেক্স ইন্ডাস্ট্রি থেকে এইজ কেয়ার সব জায়গাতেই এখন মন্দার ছায়া। চুল কাটার সেলুনের কর্মচারীদের সিংহভাগ ক্যাজুয়াল ওয়ার্কার। এখন এই কর্মচারীদের কেউ ভাইরাসটায় আক্রান্ত হলে কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তাদের চলবে কী করে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। সেলুনের কর্মচারী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলে তারা হয়তো বেকার ভাতার উপযুক্ত হবেন। কিন্তু তেমন কর্মচারী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক না হলে এবং তিনি ক্যাজুয়াল ওয়ার্কার হলে তার কাজও নেই পেমেন্টও নেই। সেলুন কর্মচারীদের সংগঠনের নেতা সে কারণে খদ্দেরদের অনুরোধ করে বলেছেন, তারা যেন তাদের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট রক্ষা করেন। সেলুনসহ নানা ব্যবসায় চলছে কাজ হারানোর ভয়।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার সব চাইল্ড কেয়ার আপাতত বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি নেওয়া যায়নি। কারণ অনেক মা চাইল্ড কেয়ারে বাচ্চা রেখেই কাজে যান। চাইল্ড কেয়ার বন্ধ করলে সেই মায়েরা কাজে যেতে না পারলে তাদের সরকারি ভাতা দিতে হবে। চাইল্ড কেয়ারগুলো যারা চালান তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেলে তাদেরও দিতে হবে সরকারি ভাতা। অস্ট্রেলিয়ার বড় একটি ইন্ডাস্ট্রি হলো এইজ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি। বাংলাদেশের সিংহভাগ বয়স্ক-অসুস্থ-অচল ব্যক্তিরা বাড়িতেই থাকেন। অস্ট্রেলিয়ার এই মানুষেরা থাকেন এইজ কেয়ার সেন্টার-নার্সিং হোমে। তাদের যাবতীয় খরচ দেয় সরকার। এগুলোয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সরা কাজ করেন। করোনা ভীতির অন্যতম টার্গেট এখন এই এইজ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি। কারণ বয়স্ক ব্যক্তিদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। খেলাধুলা বড় এক ইন্ডাস্ট্রি অস্ট্রেলিয়ার। খেলাধুলা মানেই জনসমাবেশ, টিকিট, মদ, খাবার বিক্রি। কিন্তু করোনার ভয়ে নানা খেলার আসর একের পর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কাজ হারিয়ে বেকার হচ্ছেন অনেক মানুষ। এই ঝুঁকির মধ্যে সিডনিতে শুরু হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট সিরিজ। কিন্তু সারাক্ষণ ভীতির মধ্যেই থাকছেন উদ্যোক্তারা। কারণ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনও এ অবস্থায় এ ধরনের আসর এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। ফেসবুক থেকে