সমকাল : বান্দরবানের সবুজ আর মনোরম পাহাড়ঘেরা প্রকৃতিতে বেড়ে উঠেছেন ড চিং চিং। ছোটবেলা থেকে রংতুলিতে আগ্রহ তার। নিজে নিজে শিখেছেন আঁকাআঁকি। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি থেকে আদিবাসী-গয়না জোগাড় করে সেগুলোর নকশা ভালো করে খেয়াল করলেন একদিন। তারপর গড়তে থাকলেন নতুনরূপে (ফিউশন)। পাহাড়ি সংস্কৃতি ছাড়াও তার ক্যানভাস থাকে কখনও কাচের বোতল, কখনও কেটলি, টি-পট, কখনও-বা পানদানি। রিকশাচিত্রের ঢঙেও আঁকেন ছবি। ছবি তুলে পোস্ট দিতে থাকলেন নিজের ফেসবুক পাতায়। বন্ধুরা উৎসাহ দিলেন, অনেকে কিনতেও চাইলেন। একটা সময়ে আঁকা পণ্য ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি শুরু করেন। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফিনেরি' নামে নিজের ব্যবসা।
ড চিং চিং এখন থাকেন ঢাকায়। নিজের বাসাতেই ফিনেরির পণ্য তৈরি করেন। গত বছরের শেষ দিকে বনানীতে শুরু করেছেন নিজস্ব আউটলেট। এ ছাড়া রাজধানীর কয়েকটি শপিং মলে তার তৈরি পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। এতদূর চলতে গিয়ে পাহাড়ি এ মেয়েকে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। এখনও সংগ্রাম করছেন। স্বামীর সহায়তা এবং নিজের অদম্য সাহস, ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমে এগিয়ে চলছেন তিনি। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তা এত বাধা ঠেলে ড চিং চিংয়ের মতো এগোতে পারেন না। হতাশায় উবে যায় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। আবার অনেকে একাগ্রতা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেও যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মূলধনের অভাবে জীবনে সাফল্য বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন না। আর যারা ক্ষুদ্র প্রকল্প নিয়ে শুরু করেছেন, তারাও দিন দিন ঝিমিয়ে পড়েছেন। শহরের চেয়ে গ্রামের নারীদের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সামাজিক বাধা ও সঠিক পদক্ষেপের অভাবে অনেক নারী উদ্যোক্তা সরকারের সদিচ্ছার সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে তাদের ব্যবসার প্রসার হচ্ছে না। মাঝপথে থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে তাদের।
ড চিং চিং বলেন, 'নারী ব্যবসায়ী হওয়ায় নানা বাধা মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাকে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পুঁজির অভাবে ব্যবসা বাড়াতে পারছি না। কয়েকটি ব্যাংকে ঋণের জন্য গেলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন তারা। নানা শর্তের বেড়াজাল ও জটিল পদ্ধতির কারণে লোন নিতে পারছি না। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানাই আমি।'
চিং জানান, প্রথম দিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি, কর প্রদান, ট্রেড লাইসেন্স, সরকারি সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা, এমন নানা বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হন। তাকে বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নির্ভুল তথ্য পাওয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। উদ্যোক্তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য দীর্ঘ ও জটিল পদ্ধতির ছোট ছোট, সহজ সমাধান তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তার তৈরি ডিজাইনগুলো কপি হয়ে যাওয়ায় বড় বিড়ম্বনায় পড়েছেন এ মুহূর্তে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে দুই লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে ১৬ হাজারের বেশি রেজিস্ট্রি করা স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির মাধ্যমে নারীরা শিখছেন হাতের কাজ। অবশ্য অধিকাংশ উদ্যোক্তাকেই প্রতিষ্ঠা পেতে হচ্ছে নানা বাধা অতিক্রম করে, পথের কাঁটা সরিয়ে। নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সংগঠনের মতে, সবচেয়ে বড় সমস্যা পুঁজির অভাব। ব্যবসার পরিকল্পনা করেও আর্থিক সংকটে ৯০ শতাংশ নারী পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন।
জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-এ অবশ্য বলা হয়েছে, এসএমই খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও নির্দেশনা রয়েছে, পুনঃঅর্থায়ন ঋণের কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। তবে এ নির্দেশনা মানছে না ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৭৯ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮৮ শতাংশ নারীই মনে করেন তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে মূল বাধা মূলধন।
নারী উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, স্বামীর গ্যারান্টি ছাড়া একাধিক ব্যাংক এসএমই ঋণ দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে যেসব নারী উদ্যোক্তার স্বামী নেই তাদের ঋণ গ্রহণেরও সুযোগ থাকল না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গ্রামীণ নারীদের মধ্যেও ঋণের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এসএমই খাতের এই মুহূর্তে প্রধান সমস্যা এই ঋণ সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের অজ্ঞতা বলে মনে করেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তৃণমূল নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তারা। নারী উদ্যোক্তা শামসুন্নাহার বলেন, 'এসএমই সুবিধা সম্পর্কে গ্রামীণ জনপদের নারীদের জানাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।'
রাঙামাটির মেয়ে লুসিয়া চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পাশাপাশি জামা-জুতা-ব্যাগের ছোটখাটো ব্যবসা করছেন। আরও বড় আকারে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর কথা ভাবছেন। কিন্তু এরই মধ্যে মুখোমুখি হতে হচ্ছে নানা সমস্যার। তিনি বলেন, 'একজন মেয়ে ব্যবসা করবে শুনলেই সমাজ ভাবে মেয়েটি নষ্ট হয়ে গেছে। কেউ কেউ মেয়েদের ব্যবসায়ে সরাসরি বিরোধিতাও করেন। একজন মেয়েকে ব্যবসা করতে হলে প্রথমেই লড়াই করতে হয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে।'