শিরোনাম
◈ কিছুটা কমেছে পেঁয়াজ ও সবজির দাম, বেড়েছে আলুর ◈ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় কোনো ভাষা জানেন না, সময় এসেছে তৃতীয় ভাষার ◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫

প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, ০২:১৬ রাত
আপডেট : ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, ০২:১৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

যে রোগে রোগী নিজেই নিজের হাত কাটে!

ডা. সাঈদ এনাম : অনামিকা চৌধুরীকে নিয়ে তার মা এসেছেন সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে। সঙ্গে বড় ভাই এসেছে কিন্তু ভাইয়ের সামনে সব বলা যাবে না; তাই ভাইকে তারা বাইরে বসিয়ে এসেছেন। অনামিকা বেশ ক'দিন যাবত মাথাব্যথায় নির্ঘুম কাটাচ্ছে। পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলো কিন্তু ইদানীং তার অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স খুব কম।

মাথা ব্যথার পাশাপাশি অনামিকার মা তার আরও একটি অদ্ভুত আচরণের কথা। অনামিকা সামান্য বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যে খুব রাগারাগি করে, আসবাবপত্র ভাংচুর করে। অনেক সময় ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। আসলে বসে থাকলে বললে ভুল হবে। সে তীব্র রাগ দমাতে, বা মন খারাপ কমাতে ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজেই নিজের হাত কাটে। গত মাস কয়েক থেকে এই কাটাকাটি শুরু।

অনামিকা প্রথমে আঘাতের দাগগুলো দেখায়নি। কিন্তু তার মা অনেকটা জোর করেই দেখালেন। হাতের বাহু থেকে কব্জি পর্যন্ত অনেকে গুলো কাটা দাগ। প্রায় পঞ্চাশটির মতো হবে। এগুলো সে নিজেই ব্লেড দিয়ে কেটেছে। মাঝেমধ্যে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস ও দেবার চেষ্টা করেছে। বেশ করে ঘুমের ঔষধ ও খেয়েছে।

এসব তাই বড় ভাই মোটেই জানেন না। জানলে আরও বেশি রাগারাগি বা ভয়ানক কিছু হয়ে যাবে। তাই তাকে তারা বাইরে রেখে এসেছেন। অনামিকার আচার আচরণ ভালো ঠেকছে না। ইদানীং সে খাচ্ছেও না ঠিকমতো। তাই শুকিয়ে যাচ্ছে। মায়ের কাছে অনামিকার এ সব আচরণ স্বাভাবিক ঠেকছে না। কেন অনামিকা এসব করে? কী হচ্ছে তার মনের ভেতর?
উপরে যে রোগীটির কথা বললাম সেই রোগের নাম হল ডেলিভারেট সেলফ হার্ম। আসুন এ রহস্যময় রোগ নিয়ে সামান্য জানার চেষ্টা করি। এই সেলফ হার্ম রোগ কিন্তু প্রায়ই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেখা যায়।

সেলফ হার্ম বা ডেলিভারেট সেলফ হার্ম কি?
সেলফ হার্ম হল নিজেই নিজেকে আঘাত করা। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা মুক্তি পেতেই নিজেই নিজের হাত, বুক বেøড বা চাকু দিয়ে কাটাই ডেলিভারেট সেলফ হার্ম। রোগী সেলফ হার্ম এ যদিও তীব্র মানসিক যন্ত্রণা কিছুটা উপশম পায় তথাপি মানসিক যন্ত্রণা খানিকক্ষণ পর আবারও ফিরে আসে। রোগী আবার ব্লেড হাতে নেয় আবারও কাটে। অনেকটা অবসেসিব ইম্পালসিভ ডিসঅর্ডার এর মতো, একই কাজ বার বার করা। স্বল্পতর মানসিক রোগীরা সেলফ হার্ম করে তবে তারা আত্মহত্যার উদ্দেশে এ আঘাত করেনা, তবুও দুর্ঘটনাবশত এমন ঘটে যেতে পারে।
কি কি ভাবে সেলফ হার্ম হয়?

সেলফ হার্ম কেবল বাহুতে ব্লেড দিয়ে কাটা নয়, যদি বেশিরভাগ সেলফ হার্মে আঘাতের দাগ পাওয়া যায় হাতে। তবে সেলফ হার্ম আরও অনেক ভাবে হতে পারে। যেমন-
১) বুক বা পেটের চামড়ায় ব্লেড দিয়ে কাটা
২) দেয়ালে হাত দিয়ে বা মাথা দিয়ে আঘাত করা, অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়কের মতো।
৩) হাত বা আঙ্গুল আগুন দিয়ে ঝলসে দেয়া
৪) নিজেই নিজের নখ উপড়ে ফেলা
৫) গলায় ওড়না পেঁচানো, ফাঁস দেবার চেষ্টা,
৬) মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ খেয়ে ফেলা
৭) বিষাক্ত দ্রব্য, কেমিকেল খেয়ে ফেলা
৮) খাবার দাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়া বা অতিরিক্ত খাবার খাওয়া।

এ কাজ গুলো রোগী একাকী করে, কখনো কারো সামনে নয়। অটিস্টিক বেবি ছাড়া। এরা আঘাতের স্থান সবসময় আড়াল করে রাখে। জিগ্যেস করলে এড়িয়ে চলে। মাঝেমধ্যে সেলফ হার্ম ভয়াবহ হতে পারে, হতে পারে জীবন নাশ। তাই কারো হাতে মুখে গায়ে ছোট ছোট কাটার দাগ দেখলে অথবা সেলফ হার্ম পেলে অবশ্যই তার সাথে এনিয়ে কথা বলতে হবে।
সেলফ হার্ম মানেই অন্তর্নিহিত মানসিক যন্ত্রণার লক্ষণ। সেলফ হার্ম তীব্র মানসিক যন্ত্রণার দৈহিক ভাবে প্রকাশ করা লক্ষণ। কেউ যদি তীব্র মানসিক অবসাদে বা কষ্টে ভোগে, ইমোশনাল আনস্টেবল থাকে তাহলে এ অদ্ভুত ও ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে সে কিছুটা উপশম পায় বলেই সে এমন করে। তবে আশ্চর্য হল এতে তার ব্যথা অনুভ‚ত হয়না।
সেলফ হার্ম কাদের হয়?

কিছু কিছু সামাজিক, পারিবারিক টানাপোড়েন থেকে রোগী সেলফ হার্ম করতে থাকে। যেমন কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়া, স্কুলের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়া, শারীরিক মানসিক ভাবে নাজেহাল অপমান অপদস্থ হওয়া, যৌন হয়রানির শিকার হওয়া, নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়া, প্রতারিত হওয়া, মাদকাসক্ত হওয়া ইত্যাদি।

এ সকল ঘটনা রোগীর মনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সে এ থেকে মুক্তি পথ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় এবং ক্ষণিকের উপশম পেতে সে সেলফ হার্ম করতে থাকে। তীব্র মানসিক যন্ত্রণার সময় করে বলে রোগী নিজেকে আঘাতের সময় মোটেই ব্যথা পায়না বা ব্যথা অনুভব করেনা। মানসিক যন্ত্রণা সামান্য কমলে তখন দৈহিক যন্ত্রণা বা ব্যথা টের পেতে থাকে। রোগী তখন ভাবে একাজ বা আঘাত আমি কেন করতে গেলাম। নিজে নিজেই ব্যান্ডেজ দেয়।

ডেলিভারেট সেলফ হার্ম কিছুকিছু মানসিক রোগীদের মধ্যেও দেখা যায় যেমন বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, স্কিজোফ্রেনিয়া, এনিজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। কিছুকিছু পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার এ দেখা যায় যেমন অ্যান্টি সোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, বডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার।
সেলফ হার্মের পাশাপাশি রোগীর আরও কিছু সমস্যা থাকে যেমন কানে আলগা আওয়াজ পাওয়া, কেউ আঘাত করার জন্যে কানে কানে নির্দেশ শোনা, নিজেকে অর্থহীন অপাংক্তেয় ভাবা ভাবা ইত্যাদি। তাদের ব্যক্তিত্বের সমস্যার পাশাপাশি মানিয়ে নেবার ক্ষমতা কম থাকে। যেকোনো কিছুতেই উত্তেজিত হবার প্রবণতা থাকে প্রবল। তীব্র ইমোশনালও আনস্টেবিলিটি থেকে রক্ষা পেতে রোগী সেলফ হার্ম করে।

সেলফ হার্ম ও সুইসাইড

সুইসাইডের উদ্দেশ্যে সেলফ হার্ম না করলেও অনেক সময় দুর্ঘটনাবশত সেলফ হার্মের জন্যে সুইসাইড হয়ে যায়। শতকরা ৪০ থেকে ৬০ ভাগ সুইসাইড কেস স্টাডি করলে তাদের অতীতে সেলফ হার্মের ইতিহাস পাওয়া যায়।

সবচেয়ে বেশী সেলফ হার্ম দেখা যা ১২ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে। কিশোর তরুণ থেকে কিশোরী বা তরুণীদের মধ্যে সেলফ হার্ম বেশী। অনেক সময় বয়স্কদের মধ্যে সেলফ হার্ম দেখা যায়। সেলফ হার্ম সাধারণত দেহের এমন৷ জায়গায় করে যা সহজে কারো চোখে পড়ে না। এমন কি রোগী সেটে ঘুরিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

চরম ব্যথা থেকে মুক্তি পেতেও সেলফ করে অনেকে। অটিস্টিক বাচ্চাদের অনেক সময় সেলফ হার্ম করতে থাকে। সেলফ হার্ম শুধুমাত্র মানবজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিছু কিছু জীবজন্তুর মধ্যেও সেলফ হার্ম দেখা যায়। চমৎকার কিছু পাখি আছে যারা অনেক সময় ধারালো ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের গায়ের পলক তুলে। এমন কি চামড়া বের করে খোঁচাতে দেখা যায়। পৃথিবীর সৃষ্টির অনেক কিছুই আজো রহস্যময় রয়ে গেছে।

চিকিৎসা :
ডিপ্রেশন এনজাইটি থেকে সেলফ হার্ম হলে ডিপ্রেশন এনজাইটি চিকিৎসা করতে হবে। ঘোরতর মানসিক সমস্যা থাকলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে। পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার থাকলে কাউনসেলিং সাইকোথেরাপিই, বিহেভিয়র থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে হবে।

সেলফ হার্মকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই, নেই লুকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আসুন প্রিয়জন সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত কল্পে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাই, তাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাই। সম্পাদনা: জেরিন মাশফিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়