মোঃ আঃ সবুর মিয়া: পৃথিবীর বয়স কত এই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই মতানৈক্য লক্ষ করা যায়। পৃথিবী নামক এই গ্রহে হাজার বছরের ইতিহাসে ঘটে গেছে অগণিত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। লক্ষ-কোটি মানুষ হারিয়েছে প্রাণ, উদ্ভিদ, প্রাণী, পশু-পাখি কোন কিছুই রক্ষা পায়নি দুর্যোগের হাত
থেকে। প্রবাহমান কাল থেকে মানুষ দুর্যোগের সাথে লড়াই করে জীবন প্রবাহ চালিয়ে আসছে। দুর্যোগে মানুষকে করেছে স্বজনহারা, সম্বল হারা অসহায়। মানুষ কালের পরিক্রমায় প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সেই সক্ষমতা দিয়েই পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। অতীতে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কিছু ইতিহাস তুলে ধরবো: ১৫৫৬ সালের ২৩ শে জানুয়ারি চীনের দুইটি প্রদেশ শানজির ও সানজি আট মাত্রার ভূমিকম্পে মুহূর্তেই সবকিছু মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল সমতল মরুভূমিতে রূপ নিয়েছিল দুইটি প্রদেশ মারা গিয়েছিল ৮ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ। সেই সময় এক জরিপ চালিয়ে দেখা গিয়েছিল ওই দুই প্রদেশের জনসংখ্যার ৬০ ভাগ মানুষ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছে। ১৮৩৯ সালের ২৫ শে নভেম্বর ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে যে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছিল,
পানির উচ্চতা উঠেছিল ২০ ফুটের বেশি। শুধুমাত্র পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল ২০ হাজারের অধিক মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তিন লাখেরও বেশি।
১৮৭৬ সালের অক্টোবর- ২৯ ট –নভেম্বর-০১,বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জে সংঘটিত হয়েছিল অবর্ণনীয় ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টাই ২২০ কিঃমিঃ "দ্যা গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬& quot; নামেও পরিচিত। মৃত্যু হয়েছিল প্রায় দুই লক্ষ মানুষের। কালের এক মহা-দুর্ভিক্ষে নেমে
এসেছিল।
ইয়োলো রিভার ফ্লাট, চায়নার ঘটনা হাজার ১৮৮৭ সাল চায়নার ১১ টি বড় বড় শহরে বন্যা কবলিত হয়। এতটাই ভয়াবহ বন্যা ছিল যে শহরগুলোর প্রায় সবকিছুই পানির নিচে তলিয়ে যায়, চরম ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়।মৃতের সংখ্যা ছিল নয় লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ মানুষ। ১৯৭০সাল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশ ভোলা-নোয়াখালী বর্তমানের লক্ষীপুরের উপর দিয়ে বয়ে যায় পৈশাচিক দুর্যোগের হিংস্র থাবা ১৯৭০ সালের ১২ থেকে ১৩ ই নভেম্বর যে ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব লীলা চলেছিল, সরকারি হিসাব মতে ৫ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল কিন্তু বেসরকারি হিসাবটা দুই গুন অর্থাৎ ১০ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা (ডাব্লু এম ও) সেই সময়ের এই দুর্যোগ কে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ হিসেবে ঘোষনা করেছিল। বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালের বন্যা অনেকে স্ব-চক্ষে দেখেছেন, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, গৃহহীন, বস্ত্রহীন মানুষের সংখ্যার সঠিক কোনো হিসাব নেই। লোকমুখে আমাদের দেশে এমনও কথার প্রচলন আছে “তাল গাছের মাথায় উঠেছিল কই মাছ”। দেশে সীমাহীন দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল সমগ্র দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ অঞ্চল পানিতে ডুবে গিয়েছিল ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটার জমির ফসল সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গিয়েছিল, চারিদিকে খাদ্যের অভাব, কলেরা, ডায়রিয়া প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
১৯৮৯ সাল ২৬ এপ্রিল মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর ও সাটুরিয়া আঘাত হেনেছিল ভয়ংকার প্রলয়ঙ্করী টর্নেডো, মৃত্যু হয়েছিল তেরোশোর অধিক মানুষ। ১৯৯১ সাল ২৯ শে এপ্রিল চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত এনেছিল ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়, ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ঙ্কর তান্ডবে মৃত্যু হয়েছিল এক লক্ষ ৩৮ হাজার নিরপরাধ মানুষের এছাড়াও এক
কোটির অধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালের ১১ ই নভেম্বর সিডর আঘাত হানে আমাদের দেশে, অনেক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির
ঘটনা ঘটে।
২০০৮ সালের ২৬ শে অক্টোবর রেশমি ঝড় আঘাত হানে। ২০০৯ সালে পঁচিশে মে- আইলা নামক ঝড়টি সংঘটিত হয়, মূলত ঝড়টির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতে কিন্তু বাংলাদেশের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, একই বছরের ১৯ এপ্রিল বিজলী ঝড় আঘাত হানে । মহাসেন ঝড় ২০১৩ সালের ১০ মে আঘাত হানে। আমরা ২০১৮ সালে ১১ ই অক্টোবর তিতলি ঝড়ের প্রভাব লক্ষ্য করি।।।
ফণী আতঙ্কঃ
চোখ মেলে দেখলাম ফণী, সাপের ফণা এঁকেবেঁকে কত রকম ভঙ্গিমায় দেখিয়ে দিল তার বহুরূপী চরিত্র, দেশের সমস্ত মিডিয়া, প্রশাসন, সরকারি বিভিন্ন বাহিনী, ভলেন্টিয়ার অর্গানাইজেশন ছিল সতর্ক। সব শ্রেণীর মানুষ ছিল আতঙ্কে! সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। মংলা বন্দর, পায়রা বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর ছিল পুরোটাই বন্ধ। জাহাজ গুলো ছিল বন্দরে নোঙ্গর করা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষদের সতর্ক করা হচ্ছিল। আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছিল। উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষ গুলোর মধ্যে অসংখ্য দারিদ্র্য মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেছিল। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল তাদের গৃহ পালিত পশু এবং তাদের সঞ্চিত কিছু সম্বল। আল্লাহর অশেষ কৃপায় ফনির ফনা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। মৃতের সংখ্যা এক ডজনেরও বেশি। কৃষকের ফসলহানি, কাঁচা, আধা পাকা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, ছোট বড় ও মাঝারি গাছ ভেঙে পড়েছে।
প্রবাহমান বাংলাদেশ ঝড়, বন্যা, জলচছাস,অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সূর্যের প্রখর তাপদহ, কনকনে ঠান্ডা, সব কিছু নিয়েই আমাদের জীবন। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কল্যাণে, বিশেষভাবে মিডিয়ার কল্যাণে, মানুষ দুর্যোগের আগাম বার্তা পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে। তার পরেও যদি ফণী বড় রকমের ছোবল দিত তাহলে আমাদের কতটুকু সক্ষমতা আছে দুর্যোগের প্রতিরোধ করা কিংবা দুর্যোগের পরবর্তী পুনর্বাসন পদক্ষেপ গ্রহণ করার। প্রকৃতপক্ষে দুর্যোগ প্রতিহত করা কিংবা বন্ধ করা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যেহেতু আমরা দুর্যোগ প্রবণ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করি, সেহেতু আমাদেরকে আরো বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হতে হবে, গবেষণা বাড়াতে হবে। কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ক্ষতির হাত থেকে জান,মাল রক্ষা করা সম্ভব হবে, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এখনই সজাগ হতে হবে।
E-mail: sabur2050@gmail.com