সেলিম জাহান
‘ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যেই যেতে হবে’, আমি কোনো কথা বলার আগেই খপ্ করে আমার হাতটা জোরসে ধরে বললেন তিনি। ভালো করে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সবে কলা ভবনের পেছনে গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢোকার জন্য দু’সিঁড়ি মাড়িয়েছি মাত্র। ডান দিকের ইতিহাস বিভাগের সামনের বারান্দা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে পাকড়েছেন তিনি আমাকে ওই সিঁড়িতেই। সময়টা ১৯৯০ সাল। সবে এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছে। চারদিকে বেশ চনমনে ভাব...আমাদের মনে খুশির আমেজ। ক’দিন আগেই প্রেসক্লাবের কাছে জনতার মঞ্চের পেছনে দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। শিল্পী হাশেম খানও ছিলেন সেখানে। তখনও তাকে এভাবে দেখিনি... এখন তো মনে হচ্ছে তিনি বেশ চিন্তাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্তও মনে হতে পারে। আমার নানা প্রশ্নের ও তার দ্রুত উত্তরের মাধ্যমে বিষয়টি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে এলো। এরশাদের পতনের পরে বাংলাদেশ টেলিভিশন তাৎক্ষণিকভাবে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে... গত দশ বছরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমীক্ষার ওপরে। আর সেটার সঞ্চালনের দায়িত্ব বর্তেছে মামুন ভাইয়ের ওপরে... অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ওপরে। তবে এতোসব বলার মধ্যেও তিনি আমার হাত ছাড়েননি এক লহমার তরেও... যদি পালাই। ‘রাজনৈতিক বিষয়ে বলবেন সরদার ভাই (অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম), সামাজিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করবেন বোরহান মামা (অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর) আর আপনার ভাগে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ।’ ব্যাখ্যা করেন মামুন ভাই। তারপর শুরু হয় তার অনুযোগ, ‘গত দু’দিন আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। থাকেন কোথায়? কাজের সময় পাওয়া যায় না’। যেন দায়টা আমারই। ‘কিন্তু আমার তো ক্লাস আছে একটা’, মিন মিন করে বলি আমি। ‘বাদ দেন ক্লাস। জানেন ১৫ বছর পরে সরদার ভাই টেলিভিশনে আসছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পরে আর আসেননি!’ জোর গলায় বলেন তিনি। তারপরেই ‘বারোটায় দেখা হবে’ বলে তিনি পা চালান। ‘কি হবে, কোথায় হবে’, কোনো কিছু বোঝার আগেই দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হন তিনি। তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে কেউ কখনো ধীরপায়ে চলতে দেখেছে বলে মনে হয় না।
করেছিলাম সে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান... জননন্দিতও হয়েছিলো। চমৎকার সঞ্চালনা করেছিলেন মামুন ভাই। স্বাভাবিকভাবে ভারি সুন্দর বলেছিলেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। তবে সবাই উৎকর্ণ হয়েছিলেন অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম কি বলেন তা শোনার জন্য। অপূর্ব বলেছিলেন তিনি- যদিও অতো দিন পরে এতো সব বাতি আর যন্ত্রপাতিতে খুব একটা স্বাচ্ছ্ন্দ্য বোধ করেননি। কিন্তু তাতে কি আসে যায়? ক’দিন পরে সম্ভবত দৈনিক বাংলার সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকীতে লিখেছিলেন তিনি অনুষ্ঠানটির ওপরে। সেখানে নিজেকে আড়াল করে তিনি তার তরুণ সহ-অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। আমরা প্রত্যেকে নমিত হয়েছিলাম। আজ প্রায় তিরিশ বছর পরে এসব কথা মনে পড়লো কারণ ১ মে... অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমেরও জন্মদিন। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম জন্মেছিলেন ১৯২৫ সনের ১ মে... ‘মে দিবসে’। মে দিবসে জন্ম নেয়া তো তারই সাজে। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো না, কিন্তু তার স্নেহের উষ্ণতা সবসময়েই পেয়েছি। মনে আছে, ১৯৭৪ সনে অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্তকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্যপদ প্রদান করি, তখন সে সমিতির সহসভাপতি হিসেবে আমার দেয় বক্তৃতার তিনি প্রশংসা করেছিলেন উদার কণ্ঠে বিশেষত : বক্তব্যের ‘পরিমিতিবোধের’ জন্য। সেই প্রথম আমি ‘পরিমিত’ শব্দটি শুনি এবং তার অর্থ বুঝতে পারি... ভাষাগত অর্থে তো অবশ্যই, আমার কার্যকলাপের প্রেক্ষিতেও। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে আমি যোগ দেয়ার পরে বহু জায়গায় দেখা হয়েছে... সভা-সমিতিতে, নানা অনুষ্ঠানে, শিক্ষকদের বিশ্রামাগারে। আমি তার লেখার খুব ভক্ত ছিলাম। তার ‘দর্শন-কোষ’ আমার নিত্যসঙ্গী ছিলো। তার ‘চল্লিশের দশকের ঢাকা’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’, ‘রুমীর আম্মা’ যে কতোবার পড়েছি তার হিসেব নেই। একসময়ে আশির দশকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় ফুলার রোডের ৩৫ নম্বর বাড়িতে থাকতেন।ওপরের তলায় থাকতেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সে বাড়িতে আসা-যাওয়ারকালে অনেক সময়ে নিচের তলায় থেমে গেছি সাদরে আমন্ত্রিত হয়ে। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে দু’টো বিষয় নিয়ে কথা বলতে খুব ভালো লাগত... একটি বরিশাল প্রসঙ্গ, অন্যটি শহীদ মুনীর চৌধুরী। বরিশাল শহরের বহু অজানা তথ্য জেনেছি তার কাছ থেকে। গল্প করেছেন মনোরমা মাসীমা সম্পর্কে, এ.কে. ফজলুল হক বিষয়ে, উঠে এসেছে বরিশালের জীবন ও জগত। কতো স্মৃতিচারণা করেছেন বি.এম. কলেজ সম্পর্কে। মুনীর কাকার গল্প বলতে বলতে বলেছেন রবি গুহ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেনের কথা। শুনিয়েছেন ইতিহাস, কিন্তু বলেছেন একেবারে গল্পের মতো করে। মনে আছে মধ্য আশির দশকে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির এক বনভোজনে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম দু’জনেই যোগ দিয়েছিলেন। খাওয়া শেষে দু’জনেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন। আমার মতো যে সৌভাগ্যবানেরা সে বনভোজনে গিয়েছিলেন, তারাই জানবেন, গল্প কাকে বলে।
প্রবাসে আসার পরেও যখনই দেশে বেড়াতে গেছি, তার নতুন বই সংগ্রহ করেছি। মাঝে মধ্যে দেখাও হয়েছে সভা-সমিতিতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে। কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন, তার স্নেহ-হস্তের স্পর্শ পেয়েছি পিঠে, লেখালেখির কথা জানতে চেয়েছেন। পরিবারের অন্যান্যদের খোঁজ-খবর করেছেন। শেষবার যখন দেখা হয়েছে, তখন জিজ্ঞেস করেছি, ‘কেমন আছেন, স্যার’? পরিহাসের সুরে বলেছেন, ‘মাঝের ‘ম’ টা কেটে দিন’। হেসে ফেলেছি, তিনিও হেসেছেন নিজেরই পরিহাসে। আজ বারবার মনে হচ্ছে প্রয়াত অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমকে জিজ্ঞেস করি, ‘স্যার, আপনি তো পরিহাস করে বলতেন, কেন আছেন? আমি শুধু বলি, কেন চলে গেলেন?’ ফেসবুক থেকে