শিরোনাম
◈ সাভারে শো-রুমের স্টোররুমে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ২ ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০২:৫৫ রাত
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০২:৫৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মুক্তির ভাষা কি আমরা রপ্ত করবো?

বিভুরঞ্জন সরকার : মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদানের ইতিহাস একমাত্র বাঙালিরই আছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্ত রঞ্জিত হয়েছিলো। দাবি ছিলো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। দাবিটি ছিলো অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ ছিলেন বাংলাভাষী। বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কায়েমি স্বার্থে এই চিরায়ত গণতান্ত্রিক নীতিবোধ ভেঙে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে বাঙালি তার প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান ছিলো একটি বহুভাষিক মানুষের দেশ। বাংলাভাষী সংখ্যায় বেশি। এছাড়া উর্দু, সিন্ধি, পস্তুভাষী মানুষও ছিলেন। সেজন্য বাঙালিদের দাবি ছিলো একাধিক ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কিন্তু তোলা হয়নি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়েছিলো।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তির ভাষা বুঝতো না। তারা জোরের ভাষা প্রয়োগে পারদর্শী ছিলো। আবার বাঙালির রক্তে বহমান প্রতিবাদের ধারা। সংখ্যালঘু মানুষের ভাষাকে ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে তাই বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিলো প্রথম মুহূর্ত থেকেই। এই প্রতিবাদী ধারার একটি পরিণতির দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। হ্যাঁ, ঢাকার শহর রক্তে ভাসিয়ে সারাদেশে তার দ্যুতি ছড়িয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছিলো তার ধারাবাহিকতাই আমাদের নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে, গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে। তাই একুশ আমাদের কাছে অহংকার। একুশ মানে প্রতিরোধ, একুশ মানে প্রতিবাদ। শুরুতে একুশ ছিলো শোকের দিন, শহীদ দিবস। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ২০১৯ তে এসে একুশে শোকের দিন নেই।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা এখনও নগ্নপদে প্রভাতফেরি করি, অমর ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাদের স্মৃতি তর্পণ করি, ফুলে ফুলে শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে তুলি কিন্তু পরিবেশটা আর শোক দিবসের থাকে না। একুশে এখন উদযাপন করা হয় উৎসবের মেজাজে। এতেও দোষের কিছু নেই। একুশ আমাদের শোকে মুহ্যমান হতে শিখায়নি, শিখিয়েছে প্রতিবাদী হতে, বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত হয়ে একুশের অমর সংগীত হয়ে উঠেছে। এমন বাঙালি কী আছেন যার মুখে কখনো ধ্বনিত হয়নি- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ না, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভুলিনি। আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে তখনই একুশের স্মরণ নিয়ে আমরা সাহসে বুক বেঁধেছি। সংকটে আমরা বিহ্বল হইনি। একুশ আমাদের পথ দেখিয়েছে।

৬৭ বছর পরে এসে একটি প্রশ্ন মনে খোঁচা দেয়, আমরা একুশকে আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করে ফেলছি নাতো! একুশ পালনের আয়োজনের ব্যাপকতা আছে, কিন্তু একুশের চেতনার সঙ্গে এসব আয়োজন সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কী? বাংলা আজ রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে আমরা কতোটুকু যতœবান? মাতৃভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ অটুট আছে তো? বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য বিদেশি, প্রধানত ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে বাংলাকে ‘অবহেলা’ করে ভুল করছি না তো? বাংলা ভালোভাবে শিখছি না। ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা কী ভালোভাবে শিখছি? ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা গদগদ হয়ে উঠি, নানা বোলচালে গণমাধ্যম মাতিয়ে রাখি, ফেব্রুয়ারি বিদায় নিলে আমরা বুঝি মনে মনে জপি, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’!

বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী বইমেলা এখন একুশ উদযাপনের বড় অনুষঙ্গ। বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতি বছর বইমেলা হচ্ছে। ছয় শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা বইমেলায় স্টল দিচ্ছে। এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো বই প্রকাশে কতোটুকু যত্নবান? প্রতিদিন মেলায় শত শত নতুন বই আসছে। এর মধ্যে কতোগুলো বই মানসম্পন্ন? হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসা-যাওয়া করছেন। এর মধ্যে কতোজন বই কিনছেন? সারাবছরে যদি একটি ভালো বই তিনশো কপিও বিক্রি না হয় তাহলে চলবে কেন? বই প্রকাশের সংখ্যা দেখে মনে হয় আমাদের দেশে লেখক বাড়ছেন- এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু একইসঙ্গে পাঠক না বাড়লে তো তাকে আদর্শ অবস্থান বলা যাবে না।

আমাদের সাহিত্যের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ কতোটা পাঠকদের নজর কাড়তে পারছে? সৃজনশীলতা-মননশীলতায় আমরা কী পিছিয়ে পড়ছি? বর্তমান সময়ের সেরা লেখক কে- এই প্রশ্ন যদি কারো মনে আসে তাহলে জবাব দিতে মাথা চুলকাতে হবে, একুশে উদযাপনের সময় এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সরকার দাবি করছে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। আমরা যদি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি তাহলে সেটা তো একুশের চেতনারই জয় বলে মনে হবে। কিন্তু রাজনীতির দিকে তাকালে কী আমাদের মনে হয় আমরা একুশের চেতনার আলোকবাহী? দেশের রাজনীতি সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারছে না এ দায় কার? গণতন্ত্র চর্চাতেও যে আমরা শিশুকাল অতিক্রম করতে পারছি না এটাও কী একুশে উদযাপনে আমাদের পীড়িত করে না? চিন্তনে ও মননে আমরা যদি বিকশিত হতে না পারি তাহলে একদিন হয়তো আমরা একুশের মর্মবাণী ভুলে কেবল খোলস নিয়েই মাতামাতি করবো। একুশে উদযাপনকালে আমাদের প্রত্যাশা হোক, আমরা যেমন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করবো, তেমনি মুক্তির ভাষায়ও অভ্যস্ত হবো।

লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়