ডা. মো. তাজুল ইসলাম : আমিরুল- বয়স ৩৩। সে শৈশব থেকে অটিস্টিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তারা এক ভাই ও এক বোন। বোন বিয়ে করে জার্মান চলে যায়। তার খালু ও মা চেয়েছিলো তার ওই বোনের সঙ্গে তার খালাতো ভাইকে বিয়ে দেবে। তার মা ওই ছেলেকে জামাই বাবা বলে ডাকতো। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকাতে ওই মেয়ের এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়।
আমিরুল মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও সে মা-বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়াতে তার খালু চেয়েছিলো তার সঙ্গে তার এক মেয়েকে বিয়ে দেবে। ঢাকায় আমিরুলদের একতলা একটি বাড়ি আছে। গ্রামেও প্রচুর সম্পত্তি। কিন্তু ওই মেয়ে এ রকম হাবাগোবা, কুৎসিত চেহারার,অকর্মন্য ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। এতে ওই বাবার মনে আফসোস থেকে যায়। এ কারণে সে লোক তার কনিষ্ঠ কন্যাকে আমিরুলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে।
এই মেয়েটির বয়স তখন ১২-১৩ বছর হবে। সে দেখতে শ্যামলা, কিন্তু খুবই সুশ্রী, মিষ্টি চেহারার, মায়াবতী মেয়ে। এই বিয়ে নিয়ে তাদের আত্মীয়দের মধ্যে মতানৈক্য হয়। তবে এ লক্ষ্মী টাইপের, অল্প বয়সী মিষ্টি চেহারা লাজুক মেয়েটি, বাবার কথার অবাধ্য হয় না। সে রাজি হয়ে যায়। অল্প বয়সের মেয়ে বিয়ে কী, সেক্স কী, ভবিষ্যৎ কী তেমন বুঝতো না। সবাই আশা করেছিলো ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও কিছু করতে বা বুঝতে না পারলেও তাদের একটি সন্তান হলে মেয়েটি তাকে নিয়ে কোনোভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু সে সবদিক থেকেই অপারগ। আমিরুল বউ কী, ভালোবাসা কী, সেক্স কী, দায়িত্ব কীÑ কিছুই বুঝে না। বরং তাকে খাইয়ে দেয়া, গোসল করানো থেকে শুরু করে সবকিছু এই মেয়েকে করতে হয়। নিজ মা-বাবা যা করতে হিমশিম খায়, যা করতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যায়- এ মেয়ে অবলীলায় তা করে যায়।
২-৩ বছর পরেও যখন আত্মীয়রা দেখলো আমিরুল কোনো সন্তান তো দিতে পারছেই না বরং তার তেমন শারীরিক সম্পর্ক করার চিন্তা, চেষ্টা, আগ্রহ, ধারণা কোনোটিই নেই- তখন উভয় পক্ষের আত্মীয়রা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় যে আমিরুলের বউয়ের বয়স এখনো কম আছে, সে সুন্দরী তাই এভাবে তার জীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না। সবাই তখন ওই মেয়েকে আমিরুলকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করতে বলে। কিন্তু এই ২-৩ বছরের মধ্যে মায়াবতী মেয়েটি এক মায়ার জালে জড়িয়ে যায়। সে বলে ওকে ছেড়ে যাবো চিন্তা করলেই আমার বুক ফেটে যেতো, কান্না পেতো। ভাবলাম আরেকটি বিয়ে করলে সে স্বামী যে ভালো হবে তার গ্যারান্টি কী? ও যদি আবার কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সে মেয়ে পারলে আমি কেন পারবো না? তাছাড়া আমি তো অন্য সবদিক থেকে ভালো আছি। ভালো খাচ্ছি, ভালো পড়ছি, সবার আদর পাচ্ছি। এমনকি ও আমাকে পছন্দ করে,আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত¡না দেয়। আমি একে কীভাবে ছেড়ে যাবো? ও এতো অসহায়, ও আমার ওপর নির্ভরশীল- আমি চলে গেলে ওর কী হবে? না পেলাম স্বামীর সোহাগ বা দৈহিক আনন্দ। না পারুক আমার জন্য কিছু করতে, হোক সে দেখতে কুৎসিত। সে তো সরল, অন্য পুরুষের মতো তার তো কোনো বদ স্বভাব নেই...আমার শুধু একটি সন্তান হলেই চলবে। কিন্তু এরপর আমিরুলের আরো অবনতি হয়, অস্বাভাবিক আচরণ বেড়ে যায়, সারাক্ষণ হা করে থাকে, লালা ঝড়ে। তাকে সে লালা মুছে দিতে হয়, তার খামখেয়ালিপনা, অবাস্তব আবদার মেটাতে হয়। তার দাম্পত্য জীবন বলে কিছু নেই, সন্তান তো দূরে থাক। অনেক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়েছে। সবাই বলে এর উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলে স্যার, আপনার অনেক প্রশংসা শুনে এসেছি। আমি সেক্স চাই না, ভালোবাসা, আদর চাই না, আমাকে শুধু একটি সন্তান পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। একে আমি ছাড়তে পারবো না, ছাড়ার চিন্তা করলেই কান্না আসে, বুক ফেটে যায়। ওকে সুস্থ করে আমার একটি সন্তান হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন স্যার। এ কাহিনী কী বলে : অটিজম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিজ মা-বাবারাই যেখানে থাকে অতিষ্ঠ। সেখানে একটি রূপসী, কিশোরী কী দেখে মায়ায় জড়ালো? ২. টাকাপয়সা, সম্পত্তির লোভে অনেক গরিব মা-বাবা তাদের সুন্দরী, গুণবতী মেয়েদেরও আমিরুলের মতো সবদিক থেকে প্রতিবন্ধী ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে থাকে। একদিকে প্রতিবন্ধীদেরও অধিকার রয়েছে ঘর-সংসার করার। আবার একটি গরিব ঘরের মেয়েরও অধিকার, সাধ থাকে-একজন স্বাস্থ্যবান, সুস্থ, উপার্জনক্ষম, স্বাভাবিক স্বামীর ঘর সংসার করার। এ দুইয়ের সহজ ও ভালো সমাধান কী? ৩. আমিরুলের মিষ্টি, রূপবতী বউ কিন্তু নিজ থেকে তাকে মেনে নিয়েছে। একজন কিশোরী-তরুণী মেয়ে সব ধরনের মানসিক, সামাজিক, দৈহিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত থেকেও সে আমিরুলের সঙ্গে সংসার করতে হাসিমুখে রাজি। শারীরিক আনন্দের জন্য নয়, শুধু ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার জীবনের একমাত্র চাওয়া, আকাক্সক্ষা তার যেন একটি সন্তান হয়। হোক তা ছেলে বা মেয়ে। এ যুগে এমন ত্যাগী, নিবেদিতা স্ত্রী কতোজন আছে? ৪. কিন্তু এ রকম ত্যাগ কী শুধু গরিবরা করবে? বা শুধু নারীরা করবে? কোনো পুরুষ কী এমন কোনো সবদিক থেকে প্রতিবন্ধী কোনো কুৎসিত মেয়েকে এভাবে আপন করে নেবে? এমন উদাহরণ কী আছে?
লেখক : মনোবিদ