আসিফুজ্জামান পৃথিল : উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত সমতলভূমির অনেক গল্প আছে। কিছু গল্প আনন্দের। কিছু গল্প বেদনার, প্রতিরোধের ও সংগ্রামের। উত্তরবঙ্গের দীর্ঘকালিন আন্দোলন সংগ্রামে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে তেভাগা আন্দোলন। সাম্য আর শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠার সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক অভিজাত মুসলিম পরিবারের সন্তান হাজী মোহাম্মদ দানেশ। বাংলাদেশের রাজনীতির ‘আন্ডাররেটেড’ এই রাজনীতিবিদ চিরদিন বুকের মাঝে বহন করেছেন শ্রমের প্রতি অফুরন্ত সম্মান। নিজের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত বিশাল সম্পদের প্রায় পুরোটাই বিলিয়ে দিয়েছেন ‘সর্বহারাদের’ মাঝে। একজন ধার্মিক মুসলমান এবং খেটে খাওয়া মানুষের নেতা হিসেবে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৯০০ সালে দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ছোটবেলা থেকেই পেয়েছেন উচুমানের ধর্মীয় শিক্ষা। ১৯৩১ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। ১৯৩১ সালে আলাদাভাবে আইনের সনদ অর্জন করে যোগ দেন দিনাজপুর জেলা বারে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিংশ শতকের শুরুর দিকটা মুসলিম জাগরণের যুগ। সে যুগে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের প্রায় সকল সন্তানই যোগ দিতেন মুসলিম লীগে। তবে দানেশ এর ব্যাতিক্রম।
১৯৩০ সালেই তিনি যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ায়। চিরদিন নিজের জেলাতেই দেখেছেন ভুমিহীন কৃষকের দূর্দশা। ‘আধি’ প্রথার কারণে বিপুল পরিশ্রমের পরে কৃষক তুলতো ফসলের অর্ধেক। আর ঘরে বসেই বিনা পরিশ্রমে জমির মালিক পেয়ে যেতেন অর্ধেক। দানেশ এই প্রথার বিরুদ্ধে গড়ে তুললেন দূর্বার আন্দোলন। তেভাগা আন্দোলনের মাধ্যমে ইলা মিত্রের মতো তিনিও সুর তুললেন, ‘লাঙল যার জমি তার’। ১৯৩৮ সালের মধ্যে দুইবার গ্রেফতার হন দানেশ। জমিদারদের তুমুল প্রতিরোধ আর হুমকির মধ্যেও দমেননি দানেশ। প্রায়ই বলতেন, ‘এই পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি। মহান রাব্বুল আলামিন পৃথিবীর সকল জমিনের মালিক। জমিদারদের কোন অধিকার নেই ব্রিটিশদের প্রনীত আইনে বিনাশ্রমে এই জমিন ভোগদখলের। এই জমিতে ফলিত আল্লাহর নেয়ামত সোনার ফসলের অধিকার শুধুমাত্র মেহনতি কৃষকের।’
১৯৪৫ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে মুসলিম লীগে যোগ দেন এই সাম্যবাদী নেতা। কিন্তু জমিদারদের বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কয়েক মাসেই বহিস্কার হন। ১৯৪৬ সালে আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ভারত ভাগের পর কিছুদিনের জন্য প্রকাশ্য রাজনীতি ত্যাগ করে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে গঠন করেন গণতন্ত্রী দল। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচন করে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে কেন্দ্র যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করলে আবারও গ্রেফতার হন দানেশ। পরবর্তীতে তার দল মাওলানা ভাষানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপে যোগ দেন। তিনি প্রথমে ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সারা জীবন সাম্যের গান গেয়েছেন হাজী দানেশ। সাম্যের উদাহরণ হিসেবে সবসময়ই বলতেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর কথা। তার মতে ইসলামের চাইতে বড় সাম্য আর গণতন্ত্রের উদাহরণ কোন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে পারেনি। এই মহান নেতা নিজের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত প্রায় ৭ হাজার বিঘা জমি দান করে দিয়েছিলেন। তার দান করা জায়গাতেই গড়ে উঠেছে আজকের হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন ইন্তেকাল করেন ইতিহাসের এই মহান নেতা।