মো. নাদিম হোসেন : বেশিরভাগ সময় আমরা নিজেরাই আমাদের দানব তৈরি করি। যখন করি তখন আমরা নিজেরাও তা জানি না। সময়ের সাথে সেটি এতো বিশাল হয়ে দাঁড়ায় যে, সেটির উপর আমাদের আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমাদের জন্য এমন ঘটনা অজানা না হলেও, আমরা ইতিহাস থেকে খুন কমই শিক্ষা নেই। দাম্ভিক, মূর্খ আর অপরিণামদর্শী পাকিস্তানি আমলের সরকারের কথাই ধরা যাক। তখন পূর্ব পাকিস্তানে মৌলিক অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত হওয়া ছিলো সাধারণ ঘটনা। সেই শোষণ আর বঞ্চনা থেকে সারাদেশে তৈরি হয় গণআন্দোলন, এবং শেষ পর্যন্ত জন্ম নেয় একটি নতুন জাতি। আমাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব এবং হাজারো নেতার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জন্ম দেয় আজকের বাংলাদেশ। পাকিস্তানিদের জন্য তখন আমরাই ছিলাম দানব, যার সৃষ্টি সেই সময়ের অদূরদর্শী শাসকদের হাতেই।
এখন আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। প্রথম দানবটি সৃষ্টি হয় ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে। এটি এতো বিশাল ছিলো, আর দ্রুত বড় হচ্ছিলো যে, নতুন বাংলাদেশের জন্য কালো অধ্যায়টি কারো চোখে পড়েনি। একটি জাতির জন্য খুবই দূর্ভাগ্য যে, এই কারণে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছিলো। এরপর দৃশ্যপটে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বহু উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে তিনি হত্যা করেন। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। তার তৈরি দানবেরা তাঁকে দিবালোকেই গিলে ফেলে এবং এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে দশ বছরের সামরিক শাসনের সূচনা ঘটায়। তার স্বৈরাচারি শাসনে জনগণ এতোই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো যে, তাকেও ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
আমরা এরিমধ্যে অনেক দানব সৃষ্টি করে ফেলেছি। এর মধ্য রয়েছে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, বিরোধীদের দমন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, রিজার্ভ কেলেংকারি, জোরপূর্বক গুম, সংবিধান সংশোধনী ও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার, সড়ক ও ট্রাফিক বিশৃংখলা এবং সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি। আমার কাছে মনে হচ্ছে, এসব অনিয়ম একসাথে হয়ে বড় ধরণের বড় ধরণের বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মানুষের মধ্যে ক্রোধ ও নির্মমতার জন্ম দিচ্ছে। নির্বাচন বা অন্য কিছুর অপেক্ষায় আছে, তাদের সেই ক্রোধের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে।
এমন পরিস্থিতি এড়ানো যায়, যদি আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং সাংবিধানের প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারি। সংবিধানের ১৫ ধারাতেই দেশের মানুষের সব ধরণের মৌলিক চাহিদা পূরণের রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
এটা মেনে নেয়া যায় না যে, জনগণের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করার মতো আমরা এখনো এতো উন্নত নই। কিন্তু এটা মেনে নেয়া যায় না, যখন এসব অধিকার নিশ্চিতে কোন উদ্যেগই নেয়া হয় না। এরইমধ্যে সংবিধানের বেশ কিছু সংশোধনী হয়েছে, যা বেশিরভাগই করা হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সিংহাসনকে পোক্ত ও সম্প্রসারিত করার জন্য।
বিদ্যমান সমস্যার সামাধান না করেই নিত্যনতুন ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে এবং এভাবেই সরকার বর্তমানে টিকে আছে এবং আগামীর পরিকল্পনা করছে। যেহেতু আমরা নিজেরাই আমাদের দানবকে তৈরি করেছি, তাই আজ বা আগামীকাল হোক, একদিন জেগে উঠবেই। কারণ অতীতেও এমন হয়েছে, ভবিষ্যতেও এমন হবে। আমাদের শাসকরা এমনই, যারা তাদের উত্তরসূরি থেকে শিক্ষা নেয় না। সম্পাদনা : ইকবাল খান