গোলাম মাওলা রনি : রাতবিরেতে ঘরের বাইরে বের হয়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো আমার ছোটকালের অভ্যাস। আমার বালকবেলায় আমি যখন গ্রামে থাকতাম তখন ভরপূর্ণিমার চাঁদের আলো প্রায়ই আমাকে ঘর থেকে বের করে আনত। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল সম্ভবত একটি ফসলি জমি যার কিনারে ছিল বড় বড় বেশ কয়েকটি তালগাছ। বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও হেমন্তের সন্ধ্যারাতে যখন ওইসব তালগাছের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো আমার দৃষ্টিসীমায় ধরা দিত তখন অদ্ভুত মোহে আমার অন্তরের মধ্যে কীসের যেন একটা টান অনুভব করতাম। ফলে ঘর থেকে বের হয়ে ফসলের মাঠ পেরিয়ে সেই তালগাছের তলায় গিয়ে প্রাণ জুড়াতাম। প্রায় একই ঘটনা ঘটত অমাবস্যার পূর্ণ তিথিতে। আমাদের বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়, লেবুতলা এবং পেছনের পুকুরপাড়ের গাছ-গাছালির কাছে সন্ধ্যার ঠিক পরপরই জোনাকীরা তারার হাট বসাত এবং আমাকে বাজার-সদাই করার জন্য তারা সেখানে নিমন্ত্রণ জানাত।
আমি ছিলাম আমার বংশের বড় সন্তান মায়ের নয়নের মণি এবং দাদা-দাদির কলিজার টুকরা। সমকালীন গ্রাম বাংলার বোধ ও বিশ্বাস থেকে আমার দাদি মনে করলেন যে, তার আদরের নাতির মধ্যে জিনের আছর আছে। কাজেই আমার বাম কান ফুটো করে সেখানে সপ্তধাতুর কোনো রিং পরিয়ে দিলে হয়তো রাতবিরেতে বের হওয়ার অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। কথাটি শোনামাত্র ভয়ে আমার তলপেট চিনচিন করে উঠল। আমি চিৎকার করে বলতে থাকলাম, আমার মধ্যে কোনো জিন-পরীর আছর নেই, আমি আর কোনো দিন সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বের হব না। কান ফুটো হওয়ার ভয়ে আমি গ্রামে থাকাকালে আর সন্ধ্যার পর বের হইনি। পরে যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকে আমরা গ্রাম ছেড়ে নগরের বাসিন্দা হলাম এবং তার কয়েক বছর পর মহানগরের বাসিন্দা হয়ে ইটপাথর ও যন্ত্রের বিকট শব্দের নিকট শৈশবের চাঁদের আলো এবং জুনিপোকার তারার মেলা বিসর্জন দিলাম।
পরিণত বয়সে যখন অবাধ স্বাধীনতা পেলাম তখন আবার শৈশবের ভূত আমায় পেয়ে বসল। তাই সময় পেলেই আমি রাতের বেলায় একাকী পায়ে হেঁটে ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই। আমার অফিস থেকে বাসার দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। আমি পালা করে নিয়মিতভাবে চাঁদনি রাতগুলোয় অফিস থেকে বাসা পর্যন্ত একাকী হেঁটে যাই। কানে এয়ারফোন লাগিয়ে উস্তাদ আলী আকবর খান, পন্ডিত রবিশঙ্কর, রেজা লুৎফী, উস্তাদ বড় গোলাম আলী খান অথবা বিটোভেনের কোনো সুর শুনতে শুনতে আপনমনে বিধাতার নাম জপতে জপতে ধীরলয়ে পথ চলতে আরম্ভ করি। আমার মনে কোনো ভয় কিংবা শরীরে কোনো ক্লান্তি থাকে না। আপনমনে পথ চলতে গিয়ে আমি পথের দুই ধারের সবকিছু অবলোকন করি। মাঝেমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় উজ্জীবিত হয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিই এবং বড় কোনো গাছের নিচে দুই দ- দাঁড়িয়ে এলোমেলো চিন্তায় প্রকৃতির সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে স্বর্গসুখ অনুভব করি। আমি আমার যাত্রাপথে প্রতিদিনই নতুন নতুন দৃশ্য দেখি, অভিনব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি এবং জীবন সম্পর্কে নতুন সমীকরণ রচনা করি। আজকের নিবন্ধে আমি সাম্প্রতিক কালের এক রাতের অভিজ্ঞতার কাহিনী আপনাদের শোনানোর জন্য এতক্ষণ ধরে ভূমিকা টানলাম।
ঘটনার রাতে আমি যখন অফিস থেকে বের হলাম তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ৯টা বেজে গেছে। আমার অফিস তোপখানা রোডে। সেখান থেকে ধানমন্ডির নায়েম রোডে যেতে আমি সাধারণত দুটো রুট ব্যবহার করি। প্রথমত, অফিস থেকে বের হয়ে প্রেস ক্লাব বাঁয়ে রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশ দিয়ে কদম ফোয়ারা অতিক্রম করে রাস্তা পার হয়ে হাই কোর্টের সামনে জাতীয় ঈদগাহের সদর দরজার সামনে দাঁড়াই। তারপর সিদ্ধান্ত নিই কোন দিকে যাব। কোনো দিন হয়তো মন বলে তুমি মৎস্য ভবন পাড়ি দিয়ে রমনা পার্কে ঢুকে অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশের ফুটপাথ ধরে শিশু পার্ক হয়ে শাহবাগ যাবে। পরবর্তীতে কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় পর্যন্ত গিয়ে বাঁ দিকে নিউমার্কেটমুখী হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাও। আবার কোনো কোনো দিন ওপথে না গিয়ে শিক্ষা ভবন ও সিরডাপ ভবন বিপরীত দিকে রেখে হাই কোর্টের পাশ দিয়ে এগোতে থাকি এবং কার্জন হল, শিশু একাডেমি পার হয়ে দোয়েল চত্বর পৌঁছি। এরপর জাতীয় চার নেতার মাজার অতিক্রম করে টিএসসি যাই। সেখান থেকে রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে ভিসির বাড়ি অতিক্রম করে সোজা নীলক্ষেত মোড় এবং সবার শেষে নিউমার্কেট ও গাউছিয়ার মাঝখানের কোনো একটি ফুটপাথ ধরে ঢাকা কলেজ পর্যন্ত যাই যার পেছনেই আমার বাসস্থান।
আজকের শিরোনামে বর্ণিত কুকুরটির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো সিরডাপ ভবনের উল্টো দিকের ফুটপাথের ওপর যে বৃহৎ বৃক্ষটি রয়েছে তার নিচে। এমনিতেই আমি এ স্থানটি খুব সতর্কতার সঙ্গে অতিক্রম করি। কারণ বৃক্ষের গোড়ায় প্রায়ই ছিন্নমূল লোকজন মল ত্যাগ করে রাখে যার দুর্গন্ধে যেমন মাথার চুল খাড়া হওয়ার উপক্রম হয় তেমনি কোনো কারণে এগুলোর ওপর চোখ পড়লে আর রক্ষা নেই সেই রাতে কবিতার বনলতা সেনের ঘনকালো কেশের মাঝে শান্তির পরশের অভিলাষের মধ্যেও আপনি সেই বৃক্ষতলের অঙ্গরাশের উপস্থিতি টের পাবেন। সে রাতে আমি সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় টের পেলাম যে, কোনো দুর্গন্ধ নেই। কাজেই পরিপূর্ণ সাহস-শক্তি নিয়ে বৃক্ষতলের দিকে দৃষ্টি দিতেই লক্ষ্য করলাম সেখানে একজন অর্ধউলঙ্গ মানুষ শুয়ে আছেন। লোকটির দিকে ভালোভাবে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম, তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত একজন উম্মাাদ ব্যক্তি। তিনি চিত হয়ে শুয়ে আছেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে নিজের পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাত দুটিকে বুকের ওপর আনার চেষ্টা করছেন। আমার মতো অনেক পথচারী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কেউই ছিন্নমূল পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিটির দিকে তাকাচ্ছিলেন না। অথচ একটি কুকুর সেখানে নীরবে বসে লোকটির দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
আমি যখন রাতবিরেতে হাঁটতে বের হই তখন মাঝেমধ্যে অনেক বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দু-একটি কুকুর আমার সঙ্গী হয়ে বহুদূর পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দেয়। কুকুরদের হৈ হল্লা, গল্পগুজব এবং খুনসুটির মধ্যে আমি প্রকৃতির অনেক অন্তর্নিহিত ভেদ খোঁজার চেষ্টা করি। ১০-১২টি কুকুর রাতের আঁধারে দল বেঁধে মাঝেমধ্যে কী যেন খুঁজতে থাকে। কুকুরগুলোর মধ্যে কারও কারও লেজ থাকে বাঁকানো, কেউ বা তার লেজটি পেছনের দুই পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে এগোতে থাকে। কয়েকটির লেজ বাঁকানো অবস্থায় ঊর্ধ্বে তোলা থাকে। আর দলের মধ্যে একটি কুকুরের লেজ একদম লাঠির মতো খাড়া থাকে; যার ঘাড়টি থাকে সবার থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। লেজ খাড়া করা কুকুরটির শারীরিক সৌন্দর্য, গঠন ও শক্তিমত্তা হয় ওই দলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি তার ভাবসাব ও চাউনি দেখেই বুঝতে পারি সে-ই হলো কুকুর দলের নেতা।
আপনি যদি গভীরভাবে একদল কুকুরকে পর্যবেক্ষণ করেন তবে লক্ষ্য করবেন, ওগুলোর মধ্যে যারা যুবতী ও নিজেদের সুন্দরী মনে করে তারা কোমর দুলিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে হাঁটাচলা করে দলের পুরুষ সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে, হ্যান্ডসাম কুকুরগুলো নিজেদের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য বিশেষ ভংচং করে এমনভাবে হাঁটতে থাকে যা দেখে মনে হয় তাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সামান্যতম আগ্রহও নেই। অথচ দলের ভিড় থেকে তাদের কেউ কেউ সুযোগ বুঝে একটু পিছু হটে আসে এবং ঢঙি কুকুরীর সঙ্গে গোপনে একটু রোমান্স করে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে পুনরায় এমন ভাব ধরে যেন কিছুই হয়নি। রাস্তায় চলাচলকারী লোকজনের দিকে যদি আপনি মনোযোগ দেন তবে দেখতে পাবেন, একেকজন মানুষ যেন পুরো দুনিয়ার ভার মাথায় বহন করে চলেছে। বেশির ভাগ মানুষ যারা রাতে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে যায় তাদের চোখেমুখে হতাশা ও শরীরে থাকে অস্থিরতা। যারা কোনো কথা বলতে বলতে হাঁটে, তাদের কথা শুনলে মনে হয় কোনো দেনা-পাওনা, অভাব-অভিযোগ ইত্যাদির হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে চেলেছে।
ঢাকা মহানগরীর ফুটপাথ ধরে যারা রাতবিরেতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরে তাদের মধ্যে আমি কোনো দিন ছিনতাই, ডাকাতি অথবা গুম-খুন হওয়ার আতঙ্ক লক্ষ্য করিনি। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, আমি আমার জীবনে স্বচক্ষে কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা দেখিনি। আমার মনে হয় ছিনতাইকারীরা যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ করেই অপকর্ম করে থাকে। কারণ তারা জানে, কেউ দামি জিনিসপত্র নিয়ে বা টাকাপয়সা পকেটে ভরে রাতবিরেতে একা একা হাঁটে না। সাধারণত গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিসাবি মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট পাড়া-মহল্লার স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ রাতের বেলায় নেহাৎ প্রয়োজনে বের হয় যাদের টার্গেট করে ছিনতাই বাণিজ্য কোনোমতেই লাভজনক হবে না, উল্টো ক্ষেত্রবিশেষ বুমেরাং হয়ে যায়। মোটামুটি সুস্থ ও পর্যাপ্ত সাহস না থাকলে কেউ বর্তমান জমানায় রাতের বেলায় হাঁটে না। কাজেই অপকর্মের হোতারা সব সময় এই শ্রেণির লোকজনকে যমের মতো ভয় পায় বলেই পথচারীরা বেঁচে যায়।
আলোচ্য কুকুরটির কাহিনী বলার আগে আরও কিছু ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। রাত ৯টার পর দেখা যায় বেশকিছু ফুটপাথে ছিন্নমূল মানুষ হঠাৎ করে সংসার পেতে বসেছে। অনেকটা চড়ুইভাতির মতো করে কোনো মহিলা হয়তো রান্না শুরু করেছে, কেউ বা জায়গাটি নিজেদের উঠান মনে করে ঝাড়পোঁছ করে পরিষ্কার করছে। শিশুরা যার যার মতো ছোটাছুটি করছে। কেউ বা হয়তো রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। বয়স্ক মহিলারা খোশগল্প করতে গিয়ে পরস্পরের মাথা আঁচড়িয়ে চুলের উকুন পরিষ্কার করে দিচ্ছেন এবং অদ্ভুত আলো-আঁধারির মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে একেকটা উকুন খুঁজে পাওয়ার পর সফলতার আনন্দে হেসে গড়াগড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা মাঝেমধ্যে এমন সব ভাষা ব্যবহার করছেন যা শুনলে আপনার দুঃখভারাক্রান্ত মনে পুলক সৃষ্টি হবে এবং বিষণ্ন মুখে হাসি ফুটে উঠবে। একটি উদাহরণ দিলেই আপনি তাদের কথাবার্তার ধরন বুঝতে পারবেন। দুই বয়স্ক মহিলা উকুন প্রসঙ্গে একজন আরেকজনকে খোঁটা দিতে গিয়ে বলছেন, হা-লো-মাগি! তোর মাথায় এত উকুন কী করে! এই কথা শুনে অন্য মহিলার ঝটপট উত্তর আমার ভাতার নাই তো তাই উকুন দিয়া কুরকুরাইয়্যা মজা লই...।
উপরোক্ত দৃশ্যের পাশাপাশি কিছু এলাকায় দেখতে পাবেন, পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভিক্ষুকদের জড়ো করা হয়েছে এবং তাদের ভিক্ষার অর্থ সুবিধাভোগীদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হচ্ছে। হাই কোর্ট মাজারের বাইরের গেটের সামনে রোজ রাতেই বেশ কয়েকটি জটলা বসে। তারা পাটি বিছিয়ে ১০-১২ জন গোল হয়ে বসে সম্ভবত কারও জন্য অপেক্ষা করে। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের জটলা ও আলাপ-আলোচনার হদিস করতে পারিনি। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় তারা নিজেদের আধ্যাত্মিক পুরুষ বা মহিলা সাজিয়ে বসে থাকে কোনো ধনাঢ্য-দুর্বল চিত্তের মানুষের জন্য যারা পীর-ফকিরদের কাছে ছুটে বেড়ায় নিজের ভবিষ্যৎ জানার জন্য এবং অশান্তির প্রতিষেধক ঝাড়ফুঁক-তাবিজ-কবচের জন্য। সেটির অদূরে যে বটগাছটি রয়েছে সেখানে প্রতি রাতেই বড়সড় জটলা হয়। বটগাছের সামনে এক মহিলা গরম গরম রুটি-পরোটা ও ডিম ভেজে দেন এবং ক্রেতারা বেশ সন্তুষ্ট মনে ও আয়েশি ভঙ্গিতে সেগুলো কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়েই তৃপ্তি-সহকারে খেতে থাকেন। আমার যাত্রাপথে আমি মাঝেমধ্যেই কিছু ছিন্নমূল গাঁজাখোরের সাক্ষাৎ পাই যারা মূলত জাতীয় চার নেতার মাজারের আশপাশে থাকে। তাদের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় জীবন সম্পর্কে তাদের কোনো আশা-ভরসা নেই। তারা গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে টলটলায়মান অবস্থায় ফুটপাথের কিনার ধরে ধীরে ধীরে পায়চারি করতে থাকে। তারা কোনো কথাবার্তা বলে না, এমনকি বিড়বিড় শব্দ করে অন্যসব নেশাখোর বা মাতালের মতো করে গালাগাল কিংবা খেদোক্তি প্রকাশ করে না। তাদের এ অবস্থা দেখে আমার খুব মায়া হয়। কারণ আমি জানি, লোকগুলোর কারও প্রতি ক্রোধ, ক্ষোভ বা অভিযোগ পর্যন্ত নেই। নিজেদের ব্যাপারেও তাদের কোনো ওজর-আপত্তি নেই। যদি তা থাকত তাহলে অবশ্যই তারা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তা বলে দিত।
সাম্প্রতিক কালে রাতের ঢাকার একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন তথা উন্নতি আমি লক্ষ্য করেছি। বছরখানেক আগে অফিস থেকে বের হলেই তোপখানা রোড, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে, মৎস্য ভবন, রমনা পার্ক এবং জাতীয় চার নেতার মাজার এলাকায় প্রচুর ভ্রাম্যমাণ পতিতার সাক্ষাৎ পেতাম। তাদের আচরণ অনেক সময় সভ্যতার মাত্রা অতিক্রম করত। তারা আপাদমস্তক বোরকা আবৃত হয়ে বিভিন্ন ফুটপাথে একাকী বা দলবদ্ধভাবে পায়চারি করত এবং পথচারীদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। অনেক সময় খরিদ্দার ভেবে যাকেতাকে নানা প্রলোভনে বিভিন্ন প্রস্তাব দিত যা দেখে স্পষ্ট বোঝা যেত তারা বেশ অভাবে আছে। কিন্তু ইদানীং তাদের আর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না। হতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তারা রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার খোঁজার সনাতনী পদ্ধতি বাদ দিয়ে তারাও হয়তো আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে সরাসরি কর্মক্ষেত্রে যোগদানের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেছে।
রাতের যাত্রাপথে আমার কাছে দুটো এলাকাকে সব সময় তীর্থকেন্দ্র অথবা প্রাণের মেলা বলে মনে হয়। প্রথমটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং দ্বিতীয়টি হলো শাহবাগ মোড় থেকে কাঁটাবনের দিকে যেতে আজিজ সুপার মার্কেট পর্যন্ত এলাকা। দুটো স্থানেই গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ জমিয়ে আড্ডা মারতে থাকেন। তাদের পোশাক, কথাবার্তা ও কর্মকান্ডের মধ্যে এত বৈচিত্র্য ও বর্ণিলতা থাকে যা আমাকে যারপরনাই মোহিত করে তোলে। কাজেই সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় আমি বিভিন্ন আড্ডার পাশে ক্ষণিকের তরে থমকে দাঁড়াই তাদের কথাবার্তা শোনার জন্য। আমি অবাক হয়ে তাদের রাজনৈতিক ভাবনা, সাহিত্যচিন্তা, দেশ-জাতি নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন ও বিশ্বব্যবস্থার হালচাল নিয়ে তরতাজা খবরাখবরের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুনি। তাদের কবিতা পাঠ, গান, হৈ হল্লা ও তারুণ্যের স্বাভাবিক রগরগে গালগল্পের মধ্যেও সাম্প্রতিক সময়ের বাস্তবতার অনেক অন্ত্যমিল খুঁজে পাই।
আলোচনার এ পর্যায়ে এবার শিরোনাম প্রসঙ্গের বাকি কাহিনীটুকু বলব। কারণ কথা বলতে বলতে আজ এত দূরে চলে এসেছি এবং এত প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি যার একেকটি ঘটনা নিয়েই বড়সড় একটি নিবন্ধ তৈরি করা যায়। কাজেই সবকিছু একত্রে আলোচনা করলে আজকের প্রসঙ্গ সহজে শেষ হবে না বিধায় আমরা এবার সরাসরি ক্ষুধার্ত কুকুরের অনন্য মহানুভবতার কথাটি বলে নিবন্ধের ইতি টানব। গাছের নিচে চিত হয়ে শোয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষটির বুকের ওপর কেউ হয়তো এক প্যাকেট বিরিয়ানি রেখে গিয়েছিল। লোকটি শত চেষ্টা করেও নিজের একটি হাত বুকের ওপর নিয়ে বিরিয়ানি খেতে পারছিলেন না। কারণ তার হাত-পা-শরীর সবই ছিল প্যারালাইজড। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দও বের হচ্ছিল না। কেবল চোখ ও ঠোঁটগুলোকে সামান্য নড়াচড়া করানোর সামর্থ্যটুকু তার অবশিষ্ট ছিল যা দিয়ে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বিরিয়ানিগুলো গলাধঃকরণ করে ক্ষুধা নিবারণের। তার অবস্থা দেখে মনে হলো, কেউ হয়তো তাকে দিয়ে সারা দিন ভিক্ষে করায় এবং দিন শেষে তাকে খাওয়ায় ও প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করে। আজ রাতে সেই ভিক্ষা ব্যবসায়ী হয়তো কোনো কারণে তার প্রতি রাগ করে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাস্তায় নির্জন স্থানে ফেলে রেখে অদূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে এবং মনের ঝাল মেটাচ্ছে।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষটির পাশ দিয়ে চলাচলকারী লোকজনের কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাল না। এ অবস্থায় সেখান দিয়ে একটি গর্ভবতী কুকুরও যাচ্ছিল। কুকুরটি অসহায় মানুষটিকে দেখে প্রথমে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মানুষটির বুকের কাছে বসে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করতে থাকল কী করে লোকটির মুখে খাবার তুলে দেওয়া যায়। কুকুরটি একবার তার সামনের একটি পা দিয়ে খাবারের প্যাকেটটি একটু এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আবার কী ভেবে তা করল না। কিছুক্ষণ পর সে হয়তো ভাবল তার মুখ দিয়ে খাবার তুলে সে মানুষটিকে খাইয়ে দেবে। কিন্তু খাবারের প্যাকেটটির কাছে মুখ নিয়ে সে আবার কী যেন ভাবল এবং তা করল না। এরপর সে মানুষটির মুখের দিকে অপলক নেত্রে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল এবং সম্ভবত ভাবল লোকটির মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার কাজটি একজন মানুষ করলেই ভালো হতো। এজন্য সে মানুষের সাহায্যের আশায় অসহায় লোকটির পাশে বসে করুণ সুরে কান্না আরম্ভ করে দিল।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট
(বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে নেয়া)