ডা. মো. তাজুল ইসলাম : বর্তমানে আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেটি খুবই গতিশীল, যেখানে স্বার্থপরতা, সহিংসতা, আত্মার দারিদ্র্যতা সমাজ জীবনের যেটুকু ভালো ছিল তাও অবলুপ্ত করে দিচ্ছে। এ কারণে আমাদের সেন্টিমেন্ট, চরিত্র ও সহজাত নৈতিক প্রবৃত্তিগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। মানবজীবনের নৈতিক গুণাবলীগুলো আসে এর পিছনের আবেগীয় ক্ষমতা থেকে। যারা আবেগ তাড়নার স্রোতে ভেসে যান, সহজে আবেগ তাড়িত হন, যারা আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম তাদের রয়েছে ‘নৈতিকতার ঘাটতি’। এই আবেগ তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি এবং এটি চরিত্রের মূল ভিত্তি। একইভাবে ‘পরহিতব্রতা’এর মূল উৎস হচ্ছে ‘সমব্যথি’ হওয়ার ক্ষমতা বা অন্যের আবেগ অনুভূতি সঠিকভাবে পাঠ করতে পারা ও তাদের অবস্থান থেকে তাদের কষ্টকে অনুভব করা। যদি আমরা অন্যের চাহিদা প্রয়োজন কী তা বুঝতে না পারি, তাদের হতাশা, নৈরাশ্যের কারণ বুঝতে না পারি, তাহলে কীভাবে আমরা তাদের যত্ন বা দায়িত্ব নেবো? আমাদের বর্তমান এই অস্থির, জটিল ও স্বার্থকেন্দ্রীক সমাজে দুটি নৈতিক গুণ থাকা সময়ের দাবি। সেগুলো হচ্ছে
এক. আত্ম-দমন/আত্ম সংবরণ এবং দুই. দয়া-মায়া, করুণা, সমবেদনা। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর দুর্দশাগ্রস্ত; তারা অধিক বিচ্ছিন্ন, একাকী, হতাশ, বিষণ্ন, অধিক ক্রোধান্বিত, উচ্ছৃঙ্খল, অবাধ্য ও দুর্দান্ত, অধিক উদ্বিগ্ন এবং আবেগ তাড়িত ও আগ্রাসী হওয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে এর সমাধান কী? সমাধান নির্ভর করে এদেরকে তরুণ বয়সে আমরা কীভাবে প্রস্তুত করি তার ওপর।
বর্তমানে আমরা শিশুদের আবেগীয় শিক্ষা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এর সমাধান হবে স্কুলে সকল শিশুকে কীভাবে হৃদয় ও আত্মাকে একত্র করা যায় সে নিয়ে শিক্ষা দিলে। এরিস্টটলের দার্শনিক জিজ্ঞাসা ছিল সদগুণ, চরিত্র ও ভালোত্ব নিয়ে। তার চ্যালেঞ্জ ছিল বুদ্ধি দিয়ে আমাদের আবেগীয় জীবনকে ম্যানেজ করা। আমাদের তীব্র অনুভূতি, প্রবল অনুরাগ যদি যথেষ্ট পরিশীলিত, অনুশীলন/চর্চা করা হয়, তখন সেটি প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রজ্ঞা আমাদের চিন্তাকে, মূল্যবোধকে ও আমাদের অস্তিত্বকে গাইড করে। তবে এগুলো সহজে ভেস্তে যেতে পারে এবং এই ভেস্তে যাওয়া যখন তখন হতে পারে।
এরিস্টটলের মতে, সমস্যা আবেগের মধ্যে নয়, বরং আবেগের ‘যথার্থতা/যথোচিত হওয়া’ এবং আবেগ প্রকাশের ধরনের ওপর নির্ভর করে। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে আমরা ‘বুদ্ধিকে’ আবেগের কাছে আনতে পারি, কীভাবে ‘ভদ্রতাকে’ জনপথে ও ‘কেয়ারিংকে’ সমাজজীবনে আনতে পারি। যথোচিত আবেগ বলতে কী বোঝায়? এরিস্টটলের সে বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করুন, ‘যে কেউ রেগে যেতে পারে (এবং) এটি সহজ। কিন্তু সঠিক মানুষের সঙ্গে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক উদ্দেশে এবং সঠিক পদ্ধতিতে রাগা (মোটেই) সহজ কাজ নয়’।
লেখক : অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট