কাকন রেজা : শরীর ভালো না থাকলে নাকি কিছুই ভালো লাগে না। নিজের শরীরও ভালো নেই। মেরুদ-ের ব্যথায় রীতিমত শয্যাশায়ী। ভয়াবহ ব্যথা, নড়লে ব্যথা এবং চড়ারতো অবস্থাই নেই। তবে মাথাটা পরিষ্কার, লজিকও ঠিক আছে। মুশকিলটা ওখানেই। লেখার জন্য হাত নিশপিশ করে, অথচ ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে লেখার কাজটা প্রায় দুঃসাধ্য। তারপরেও অভ্যাস বলে কথা। প্রবাদে আছে না, ‘অভ্যাসের কুকুর শুয়ে ভোগে’, সেই অবস্থা আর কী।
যা হোক, শরীরের অবস্থা এবং লেখার ইচ্ছা দুটো মেলাতে গিয়ে যে বিষয়ে লিখতে চাচ্ছিলাম তা টপকে মনে এলো সম্প্রতি করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা। ‘মনের ইচ্ছা ও শরীরের অসঙ্গতি’র সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়টিও যায়। মন চাচ্ছে কিন্তু শরীর দিচ্ছে না। মনটা লেখক, শরীরটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর লেখাটা হলো সেই দুঃসাধ্য প্রয়াস। এ অবস্থায় ‘বহিবারে দাও শক্তি’ বলা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই।
অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন আইনটি নিয়ে। বিশেষ করে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। রাজনৈতিক কারণে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও এক্ষেত্রে সবাই গাচ্ছেন প্রায় অভিন্ন সুরে। যেমন সুর দেখতে পাই সংসদে এমপিদের ট্যাক্স ফ্রি গাড়ির বেলায়। তখন সবার ঐক্যমত। ‘ভোগে’ আর ‘বিপদে’ সবারই সুর এক হয়ে যায়। এর বাইরের সময়টাতেই বেসুরো গায় সবাই। অথচ সে সময়টুকু সবাই সুরে থাকলে কতিপয়ের ভোগের ভাগ পেতো সবাই, ভোগ পরিণত হতো আনন্দে। আর বিপদের সময়টুকুও আসতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওই যে, ‘কভু আশী বিষে দংশেনি যারে’। দংশন হলেই যন্ত্রণা, যন্ত্রণা হলেই উপশমের চিন্তা।
নিজের শরীর নিয়েই বলি। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কোমর থেকে নিচের দিকে ব্যথা হচ্ছিল। ডাক্তার বলছিলেন, ব্যায়াম করতে, ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যেতে, যাইনি। চলতে পারছিলাম বলেই অতটা পাত্তা দেয়া হয়নি। তেমনি কিছু ব্যাপারে, সে হোক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা অন্য কিছু, অনেকেই পাত্তা দিচ্ছেন না, চলছে বলে। ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’, এক সময় চলা বন্ধ হয়ে যাবে। ওই যে গোপনে দেনা বাড়ছে, বিছানায় শুয়ে সেই ঋণ শোধ দিতে হবে। অসুস্থতায় দেনা শোধ করতে হয় বিছানায় শুয়ে, আর অন্য দেনা শুধতে হয় কপাল চাপড়ে।
যে বিষয়ে লিখতে চেয়েছিলাম সেটা বাদ দিয়ে ‘শিবের গীত’ গাইছি। করার কিছু নেই, দক্ষিণ এশিয়ার বাতাসটাই এমন, কাজের চেয়ে কাজের ভূমিকাটাই বড় হয়। অনেকটা কায়ার চেয়ে ছায়া বড় হবার মতন। দেখলাম সামাজিকমাধ্যমে একজন লিখেছেন একটি সেতুর উদ্বোধন নিয়ে। সেখানে প্রতিপাদ্য ‘সেতু’টির বদলে ঠাঁই পেয়েছে দু’হাজার শব্দে ‘উদ্বোধনকারী’র মহিমা। বুঝুন অবস্থা। ইচ্ছা করছিল প্রশ্ন করি, মহিমান্বিত উদ্বোধকের কাজটা আসলে কী? সেতো দায়িত্বপ্রাপ্তই হয়েছেন এমন কাজের জন্য, এর বাইরে ‘এক্সট্রা-অর্ডিনারি’ কিছুতো করেননি। সেই ‘গুনি’র কাজইতো রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্টসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। বরং যে কাজগুলি এখনো হয়নি সেগুলোই আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত। অর্থাৎ তিনি যেখানে ব্যর্থ তার আলাপ তোলা উচিত। কদিন আগে জাপানের একটি স্থাপনা বিষয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু ওই স্থাপনা কে উদ্বোধন করেছিলেন, সে নামটি কোথাও খুঁজে পাইনি। বরং নকশাবিদের নাম পেয়েছি, কারা তৈরি করেছে সে নাম পেয়েছি, কিন্তু উদ্বোধক বেচারি লাপাত্তা। অতএব নিজ ট্যাক্সের পয়সায় করা কাজের ভাগীদার অন্যকে বানাবার আগে ভেবে দেখা দরকার, আমরা তাহলে ট্যাক্স দিই কী কারণে। সাথে ভেবে দেখা দরকার, উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমরা কতটা বেশি বা কম ট্যাক্স দিই এবং উন্নত বিশ্বের সাথে সে তুলনায় আমাদের সাযুজ্যটা কী।
আবার বিষয় থেকে সরে গেছি। ওই যে অভ্যাসের দাস, শিবের গীতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ধান ভানতেও তাই চলে আসে। তবে না বলা কথার মধ্যেও একটি কথা বলি, ক্ষেত্র যাই হোক, শারীরিক বা অন্য কিছু, মেরুদ- ক্ষয়ে গেলে বিছানায় শুয়ে ভোগা এবং কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান
লেখক : কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক।