ডেস্ক রিপোর্ট : দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা ও বুড়িমারী স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি স্থলে শতভাগ দুর্নীতি হয় বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। মোংলা বন্দর ও কাস্টমস হাউস এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশনে প্রতিবছর ৩১ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হয় বলে জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটির মতে, মোংলা-বুড়িমারীতে প্রতিটি সেবা নিতে হয় ঘুষের মাধ্যমে। ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না।
গতকাল রবিবার টিআইবির কার্যালয়ে ‘মোংলা বন্দর ও কাস্টমস হাউস এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন : আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশনে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমপক্ষে ১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা অবৈধ লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শুল্ক স্টেশনে আমদানির ক্ষেত্রে ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩৪ লাখ টাকা। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ আমদানির ক্ষেত্রে অবৈধভাবে ৪৩ লাখ টাকা ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা আদায় করেছে। এ ছাড়া ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা মোটর শ্রমিকদের পকেটে গেছে।
একইভাবে মোংলা কাস্টমস হাউস ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গাড়ি থেকে ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, কন্টেইনার থেকে ৭ কোটি ৯০ লাখ এবং বাল্ক থেকে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা অবৈধভাবে নেয়া হয়েছে। মোংলা বন্দরের মাধ্যমে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে আদায় করা হয়েছে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে গাড়ি থেকে ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, কন্টেইনার থেকে ১ কোটি ২৬ লাখ এবং বাল্ক থেকে ৫৮ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী, মোংলা বন্দর দিয়ে যে কোনো পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অবৈধভাবে টাকা দিতে হয় ব্যবসায়ী বা তাদের প্রতিনিধিদের। আমদানি পণ্যের প্রতিটি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে শুল্কায়নের জন্য কাস্টমসে ৩৫ হাজার ৭০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। আবার একই পণ্য বিকাল ৫টার মধ্যে ছাড় করাতে লাগে ছয় হাজার টাকা। এরপর ছাড় করাতে আরো লাগে অতিরিক্ত এক হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়ায় কাস্টমস হাউসে আট হাজার ৩৫০ টাকা ও বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ২১ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়।
এদিকে বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশনে আমদানি পণ্যের প্রতিটি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে শুল্ক স্টেশনে এক হাজার ৭৫০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। রপ্তানির বেলায় দেড় হাজার টাকা গুণতে হয়। আবার আমদানি করা পণ্য ছাড় করাতে স্থলবন্দরের কর্মকর্তাদের ৩০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। রপ্তানিতে এই ঘুষ ২০০ টাকা।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোংলা কাস্টমস হাউস থেকে ৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা এবং বন্দর থেকে ২২৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এদিকে, বুড়িমারী কাস্টমস হাউস থেকে ৪৫ কোটি এবং বন্দর থেকে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসা নিয়ম বহির্ভূত লেনদেন বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতির শিকার হয়ে নিজেরাও দুর্নীতির অংশীদার হয়ে যাচ্ছে তাদের তথ্য ও অন্যান্য অংশীজন থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করেছি। আমাদের গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী এটি প্রমাণিত হওয়ায় আমরা এটিকে (অবৈধ লেনদেন) দুর্নীতি বলছি।
দুই বন্দরে অটোমেশন ও ওয়ান স্টপ সেবা চালু হলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সার্বিক তথ্য উদ্বেগজনক। উভয় প্রতিষ্ঠানেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কাঠামো ব্যবস্থা উপস্থিত থাকলেও তা প্রায়োগিক পর্যায়ে নেই। এ জন্য সব পর্যায়ে ওয়ান স্টপ ও অটোমেশন ব্যবস্থা চালু নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণা ও প্রতিবেদন তৈরি করেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষক খোরশেদ আলম, মাহমুদ হাসান তালুকদার ও মনজুর ই খোদা। সূত্র : ভোরের কাগজ